অথবা, বাংলাদেশে ভিক্ষাবৃত্তি সমাধানের পথ আলোচনা কর।
অথবা, ভিক্ষাবৃত্তি দূরীকরণে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়? আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বাংলাদেশ একটি দরিদ্র ও জনবহুল দেশ। এদেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব হচ্ছে ৯১৬ জন। এদেশে জনসংখ্যার ঘনত্বের ন্যায় অনেক সমস্যা রয়েছে, যা এদেশকে সমস্যাবহুল করে তুলেছে। এদেশের অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে অন্যতম একটি সমস্যা হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি। এসব সমস্যা বর্তমানে সামাজিক সমস্যায় রূপান্তরিত হয়েছে, যা সমাজের জন্য হয়ে উঠেছে মহাঘাতক ব্যাধির ন্যায় মারাত্মক। দেশের বিপুল পরিমাণ ভিক্ষুক রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য বোঝা, অনুৎপাদনশীল জনগোষ্ঠী এবং জাতীয় আয়ের এক বিরাট অংশ অন্ন ধ্বংসকারী। তদানীন্তন পাকিস্তানের সামাজিক অনাচার বিলোপ কমিশনের প্রতিবেদনে ভিক্ষাবৃত্তিকে মারাত্মক সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে এটাকে সবচেয়ে বেশি স্থায়ী ও সংকটময় অবস্থা বলে বর্ণনা করা হয়েছে এবং A symptom of social disorganization হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ভিক্ষাবৃত্তি দূরীকরণের উপায় : ভিক্ষাবৃত্তি বাংলাদেশের সমাজে অন্যতম প্রধান সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে । বাংলাদেশে ভিক্ষাবৃত্তি দূরীকরণের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যায় ঃ
১. অর্থনৈতিক উন্নয়ন : বাংলাদেশে ভিক্ষাবৃত্তি দূরীকরণের জন্য সর্বাগ্রে অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রয়োজন। দেশে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, উৎপাদন বৃদ্ধি, তথা অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন সম্ভব হলে ভিক্ষাবৃত্তি দূর করা সম্ভব।
২. কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি : দেশের প্রায় তিন কোটি মানুষ বেকারত্বের অভিশাপে দিন কাটাচ্ছে। কোন কাজ না পেয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে মানুষ ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণে বাধ্য হয়। দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ভিক্ষাবৃত্তি দূর করা সম্ভব ।
৩. শারীরিক বিকলাঙ্গদের পুনর্বাসন : শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ ব্যক্তিরা (শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ) কাজের ক্ষমতা হারিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করে। তাদেরকে পুনর্বাসিত করা গেলে ভিক্ষাবৃত্তি দূর করা যায়।
৪. সরকারি স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করা : দেশের সাধারণ মানুষ রোগব্যাধির কারণে সহায়সম্বল হারিয়ে ফেলছে। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা উন্নতকরণ, পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণ প্রভৃতি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দরিদ্রদের সেবা দেওয়া যায়। দরিদ্র জনগণ উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে সুস্থ হয়ে গেলে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করে না। তাই
৫. বিবাহবিচ্ছেদ কমিয়ে আনা : স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সদ্ভাব বজায় রাখা সম্ভব হলে বিবাহবিচ্ছেদ কমিয়ে আনা সম্ভব। তাছাড়া সমাজ থেকে ধর্ষণ, অপহরণ দূর করার মাধ্যমে ভিক্ষাবৃত্তিকে দূর করা যায়।
৬. প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা : প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা বা দূর করা মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। তবে মানুষ প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করতে পারে। দুর্যোগপরবর্তী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারে। মানুষের দুর্যোগপরবর্তী যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে ভিক্ষাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব।
৭. ধনবৈষম্য দূরীকরণ : বাংলাদেশের সমাজে ব্যাপকভাবে ধনবৈষম্য বিদ্যমান। উত্তরবঙ্গের মঙ্গাপীড়িত মানুষ যখন অনাহারে অর্ধাহারে দিনের পর দিন কাটায় তখন ঢাকা শহরের বড় বড় শপিং কমপ্লেক্সে মানুষ গহনা, চুড়ি, লেহেঙ্গা কিনতে ভিড় জমায়। তাই ভিক্ষাবৃত্তি দূরীকরণের জন্য এরূপ ধনবৈষম্য অবশ্যই দূর করা প্রয়োজন।
৮. জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাস : বাংলাদেশে বর্ধিত জনসংখ্যা সব সমস্যার মূলে অবস্থান করছে। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস করা গেলে ভিক্ষাবৃত্তি দূর করা সম্ভব ।
৯. ধর্মীয় মূল্যবোধের সঠিক ব্যাখ্যা : মানুষ ধর্মীয় মূ
ল্যবোধের অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহারের মাধ্যমে ভিক্ষা করে। ধর্মীয়
মূল্যবোধের সঠিক ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে ভিক্ষাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন ।
১০. সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিস্থিতি : রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখাসহ সুষ্ঠু বাজার নীতি, দরিদ্র হিতৈষী বাজেট প্রণয়ন, সুষ্ঠু সরকারি নীতি প্রবর্তনের মাধ্যমে সমাজ থেকে ভিক্ষাবৃত্তি দূর করা যায়।
১১. আইন প্রয়োগ : দেশে ভিক্ষাবৃত্তি বিরোধী আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। প্রয়োজনে ভিক্ষুকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে ভিক্ষাবৃত্তি দূর করতে হবে।
১২. শিশুদের পুনর্বাসন : মা-বাবা হারা ও পরিত্যক্ত শিশুরা যাতে ভিক্ষাবৃত্তির সাথে জড়িয়ে না পড়ে এজন্য তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৩. সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা : বৃদ্ধ, শিশু, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, রোগগ্রস্তদের সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে সমাজ থেকে ভিক্ষাবৃত্তি দূর করা যায়।
১৪. ভিক্ষুকদের নিয়ে গবেষণা : মানুষ কেন ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করে, এর ফলে সমাজে কি কি সমস্যার উদ্ভব হয়, কিভাবে এ সমস্যা দূর করা যায় প্রভৃতি বিষয় নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করা প্রয়োজন। ভিক্ষুকদের সমস্যা সমাধানের পথ উন্মোচন, ভিক্ষাবৃত্তিতে উৎসাহিত করার পথ রুদ্ধকরণ প্রভৃতি বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা চালাতে হবে। এভাবে গবেষণার মাধ্যমে সমাজ থেকে ভিক্ষাবৃত্তি দূর করা সম্ভব।
১৫. শিক্ষার প্রসার : মানুষকে শিক্ষিত করার মাধ্যমে আত্মসচেতন গোষ্ঠীতে পরিণত করা সম্ভব। শিক্ষা মানুষের বিবেকবোধ জাগ্রত করে। একজন বিবেকবান মানুষ ভিক্ষাবৃত্তিকে সাধারণভাবে ঘৃণা করতে শিখে।
১৬. ভিক্ষাকে নিরুৎসাহিতকরণ : ভিক্ষুকদের কোন প্রকার সাহায্য দান করা থেকে বিরত থাকলে তারা এক সময় ভিক্ষাবৃত্তির প্রতি নিরুৎসাহ বোধ করবে এবং এভাবে ভিক্ষাবৃত্তি হ্রাস পাবে
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে ভিক্ষাবৃত্তির গতি হ্রাস করা সম্ভব। শুধু পরিকল্পনাহীন ও উদ্দেশ্যহীন পুলিশি অভিযানের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান আশা করা যায় না। এ সমস্যার যেমন ধারাবাহিকতা রয়েছে, তেমনি ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমেই এর মোকাবিলা করতে হবে। জীবনধারণের তাগিদেই ভিক্ষুকরা সমাজ গর্হিত বৃত্তি গ্রহণ করেছে, এর জন্য তারা দায়ী নয়। এ সত্য উপলব্ধি করে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এ সমস্যার মোকাবিলা করা বাঞ্ছনীয়। কেবল সহানুভূতি প্রদর্শনের মাধ্যমে এ সমস্যার মোকাবিলা সম্ভব নয়।