অথবা, বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : কোন সভ্য সমাজের জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটি ভয়াবহতম পরিণতি নিয়ে আসে। বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে এমন একটি অবস্থানে রয়েছে যেখানে কোন না কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিরাজমান থাকেই। আর এর মধ্যে বন্যা বাংলাদেশের জন্য একটি নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিণতিতে বাংলাদেশ সীমাহীন সমস্যায় আক্রান্ত। বিশেষ করে অর্থনৈতিক দুরবস্থার পাশাপাশি অবকাঠামোগত বিপর্যয় নেমে আসে এ.দুর্যোগের কারণে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলাফল : প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলাফল সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
১. অর্থনৈতিক সংকট : প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে একটি দেশে সবচেয়ে বেশি যে ক্ষতি হয় তা হলো দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ে, হাজার হাজার কোটি টাকা নষ্ট হয়ে যায়, যার ফলে জিডিপির হার একেবারে হ্রাস পায়। আবার এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় লেগে যায়। যেমন- সম্পদশালী দেশ আমেরিকাতেও ক্যাটরিনার আঘাতে
ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনৈতিক অবস্থা কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় লেগে যায়।
২. জানমালের ক্ষয়ক্ষতি : প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প প্রভৃতি কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ব্যাপক জানমালের ক্ষতি সাধিত হয়। যেমন- বন্যার প্রাদুর্ভাবে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। ভূমিকম্প ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে সাথে সাথে সম্পদও নষ্ট হয়।
৩. অবকাঠামোগত বিপর্যয় : প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অবকাঠামোগত বিপর্যয় ঘটে। যেমন- বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প প্রভৃতির ফলে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, যোগাযোগ ব্যবস্থা সবকিছু বিনষ্ট হয়ে যায় এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যার ফলে পরিণতি আরও ভয়াবহ হয়।
৪. মহামারি রূপ ধারণ : দুর্যোগ পরবর্তী পরিস্থিতি বেশ ভয়ংকর হয়। কারণ দুর্যোগকালীন এলাকায় খাবার পানি,
ঔষধ, বাসস্থান প্রভৃতির তীব্র সংকট দেখা দেয়। ফলে পরিস্থিতি মহামারি আকারে দেখা দেয়। হাজার হাজার মানুষ এ পরিস্থিতির শিকার হয়।
৫. খাদ্য ঘাটতি : একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংশ্লিষ্ট এলাকার ফসল নষ্ট করে। উৎপাদন একেবারে শূন্য পর্যায়ে নিয়ে আসে এবং ক্রমশ খাদ্যের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়। যার ফলে বৈদেশিক ত্রাণের অপেক্ষায় দিন গুনতে হয়।
৬. উৎপাদন হার কমতি : প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি প্রভৃতির কারণে শস্য ও ফসলাদি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বীজ স্বল্পতা এবং উৎপন্ন ফসলের অনুর্বরতার কারণে উৎপাদন হার কমে যায়। ফলে খাদ্য সংকট দেখা দেয়।
৭. উন্নয়নের গতি শ্লথ : প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে কোন দেশের জন্য কাম্য নয়। কারণ এটি সঠিক উন্নয়নের গতিকে একেবারে থমকে দেয়। বিশেষ করে দুর্যোগ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে পুনরায় উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করতে বেশ সময় লেগে যায়।
৮. বৈদেশিক ঋণের উপর নির্ভরশীল : দুর্যোগ কবলিত দেশ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পঙ্গু হয়ে যায়। তাদের অর্থনৈতিক কাঠামো একেবারে ভেঙে পড়ে। ফলে সাহায্যের জন্য বৈদেশিক অনুদানের (Foreign aid) উপর নির্ভর করতে হয়। দেশ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
৯. পরিবেশ দূষণ : প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতির কারণে পরিবেশ ব্যাপকভাবে দূষিত হয়ে যায়। পরিবেশ দূষণের কারণে মানুষ নানা রোগে ভোগে এবং স্বাস্থ্যগত সমস্যায় আক্রান্ত হয়।
১০. বনায়ন ধ্বংস : প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে দেশের গাছগাছালি এবং বনায়ন প্রক্রিয়া ধ্বংস হয়ে
যায়। বন্যা, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, খরা প্রভৃতি কারণে বনের গাছগাছালি ধ্বংস হয়ে যায়, যার ফলশ্রুতিতে পরিবেশ দূষিত হয়।
১১. মরুকর
ণ : প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ভূপৃষ্ঠের এক অঞ্চল প্লাবিত হয় এবং অন্য অঞ্চল মরুকরণের সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিন খরা এবং বৃষ্টিহীনতার কারণে মরুকরণের সৃষ্টি হয়।
১২. বেকারত্ব বৃদ্ধি : প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত অঞ্চলে সবকিছু স্থবির হয়ে যায়। মানুষের কর্ম হ্রাস পায়। উৎপাদন মুখর কর্মকাণ্ড থেমে যায় । ফলে কর্মের অভাবে মানুষ বেকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
১৩. সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি : সন্ত্রাস জটিল পরিবেশের ফলশ্রুতিতে ঘটে থাকে। কারণ মানুষ যখন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের করাল গ্রাসে নিপতিত হয় এবং সবকিছু থেকে বঞ্চিত হয় তখন সে এ পন্থা বেছে নেয়। তখন মানুষ বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়ে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ এভাবে মানুষকে নিঃস্ব করে পথে নামাতে বাধ্য করে।
১৪. দারিদ্র্যের সংখ্যা বৃদ্ধি : কথায় বলে ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ এ কথাটি অতীব সত্য, যেমন- দারিদ্র্যপীড়িত দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগে থাকে। যেমনটা বাংলাদেশে হয়ে থাকে। এমনিতেই দারিদ্র্যের করাল গ্রাসে নিমজ্জিত তারপর আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিত্যদিনের সঙ্গী। তাই এদেশের দুরবস্থা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১৫. দুর্নীতি বৃদ্ধি : দুর্যোগ কবলিত এলাকায় অর্থনৈতিক কাঠামো একেবারে ভেঙে পড়ে। ফলে মানুষ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দারিদ্র্যের শিকার হয়। সামাজিক বৈষম্য Unequal distribution of wealth প্রভৃতির কারণে মানুষ ক্রম- দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ধনী দরিদ্রের মধ্যে এ অসম বৈষম্যই মানুষকে নৈতিক স্খলন ঘটাতে সহায়তা করে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটি দেশের জন্য অভিশাপস্বরূপ এটা কোন জাতির জন্য কাম্য নয়। কারণ এর ফলশ্রুতিতে জনজীবনে নেমে আসে মহা বিপর্যয়। হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ.প্রভৃতি পরিস্থিতির জন্যও পরোক্ষভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দায়ী। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাটিয়ে উঠার মত সাহস, শক্তি এব সম্বল আমাদের বৃদ্ধি করা উচিত।