বাংলাদেশে পতিতাবৃত্তির কারণগুলো কী কী? আলোচনা কর ।

অথবা, বাংলাদেশে পতিতাবৃত্তির কারণসমূহ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাংলাদেশে পতিতাবৃত্তির বৃদ্ধির কারণ বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বাংলাদেশ একটি সামাজিক সমস্যাগ্রস্ত দেশ। এদেশের অনেকগুলো সামাজিক সমস্যার মধ্যে অন্যতম সামাজিক সমস্যা হচ্ছে পতিতাবৃত্তি। পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য, বর্বর, ঘৃণ্য ও আদিম বৃত্তি হচ্ছে পতিতাবৃত্তি। এটি নগরসভ্যতার জন্য অভিশাপ। সকল প্রকার ধর্মীয়, সামাজিক নিয়মনীতি এবং আদেশকে উপেক্ষা করে সূদুর প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান সভ্যজগতেও এ প্রথাটি টিকে আছে এবং ভবিষ্যতেও সমাজজীবন থেকে এ ঘৃণিত পেশা বিদূরিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বরং সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে পতিতাবৃত্তি আরও সৌখিন এবং মার্জিত রূপ পরিগ্রহ করছে।
বাংলাদেশের পতিতাবৃত্তির কারণসমূহ : পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের সময় থেকেই পতিতাবৃত্তি নামক সামাজিক সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। পতিতাবৃত্তি সমাজের আদিমতম সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পূর্ব থেকেই পতিতাবৃত্তি নামক সামাজিক সমস্যা বিরাজ করছে। বাংলাদেশে পতিতাবৃত্তির কারণ নানাবিধ । নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. অর্থনৈতিক মন্দা : বাংলাদেশের প্রায় সব পতিতাই অর্থনৈতিক মন্দা অবস্থার কারণে এ বৃত্তি গ্রহণ করে। দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা দারিদ্র্য কাটিয়ে উঠার জন্য এ বৃত্তি বেছে নেয়। “Necessity knows no law.” ইংরেজি এ প্রবাদ বাক্যটি বাংলাদেশের পতিতাদের মুখের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়ে উঠে। তাদের মুখচ্ছবিতে অভাবের তাড়নার একটি স্পষ্ট
প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। অর্থের বিনিময়ে তারা তাদের দেহকে বিলিয়ে দিতে বাধ্য হয়।
২. উত্তরাধিকার : পতিতাদের সন্তানরা পতিতাদের ন্যায় সমাজে নিম্ন মর্যাদা পায়। সমাজ তাদেরকে একঘরে করে রাখে। ফলে পতিতার সন্তানেরা পতিতায় পরিণত হয়। ছোটবেলা থেকে মায়ের পাশাপাশি থেকে তারা এ পেশাকেই গ্রহণ করতে শিখে । সমাজে তাদের মর্যাদা কম থাকায় অন্য পেশা গ্রহণের সুযোগও কম থাকে।
৩. শিল্পায়ন ও শহরায়ণ : আধুনিক সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শিল্পায়ন ও শহরায়ণ। শিল্পায়ন ও শহরায়ণের এ যুগে মানুষের জীবনপ্রবাহে অনেক পরিবর্তন এসেছে। মানুষ গ্রাম ছেড়ে কাজের আশায় শিল্পায়িত এলাকায় আগমন করে। তারা তাদের স্ত্রী থেকে দীর্ঘদিন দূরে অবস্থান করে। আবার ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের গার্মেন্টস কর্মীরা সকলে যুবতী, তারা সবাই বিবাহিত নয়, যৌন চাহিদা পূরণের জন্য তারা শিল্পের শ্রমিকদের সাথে মিলিত হয়।
৪. প্রলোভন : বাংলাদেশের মানুষ খুবই সহজ সরল প্রকৃতির। গ্রাম বাংলার মানুষ প্রকৃতির সান্নিধ্যে বসবাস করতে গিয়ে আরও সহজ সরল হয়ে উঠে। তাদেরকে দালালচক্রের অসাধু লোকজন ভালো চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে শহরে নিয়ে আসে । উচ্চতর জীবনযাপনের প্রলোভনে পড়ে গ্রামের সহজ সরল মেয়েরা শহরে এসে দুষ্টদের খপ্পরে পড়ে পতিতাবৃত্তি গ্রহণে বাধ্য হয় ।
৫. প্রতারণা : আমাদের সমাজে অনেক মেয়ে বিবাহ, চাকরিসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার সংস্পর্শে এসে প্রতারিত হয় । ঢাকা শহরে অনেক চাকরিজীবী মেয়েদের চাকরি দেওয়ার নাম করে বা চাকরি দিয়ে দেহ ভোগ করে। শহরের অনেক সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবী বাহ্যিক একটি নিয়োগপত্র তৈরি করে অবাধে যৌনাচারে লিপ্ত হচ্ছে। দেশের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের মেয়েরা এরূপ পতিতাবৃত্তির সাথে জড়িয়ে পড়ছে।
৬. বিশ্বাসঘাতকতা : অনেক মেয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হচ্ছে। বিবাহের পরে স্বামী স্ত্রীকে বাধ্যতামূলক পতিতাবৃত্তিতে অংশগ্রহণ ছাড়াও স্ত্রীকে রেখে স্বামী পালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে অনেক মেয়ে পতিতায় পরিণত হচ্ছে। ড. শামসুল আলম বাংলাদেশে পতিতাবৃত্তির কারণ বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে একটি ছকের উপস্থাপন করেছেন।
৭. পারিবারিক বিশৃঙ্খলা : বাংলাদেশের পতিতারা কোন না কোনভাবে পারিবারিক বিশৃঙ্খলার শিকার। একক পরিবার গঠন, দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা, শিক্ষাহীনতা, দেরিতে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদসহ পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যার কারণে পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করছে। কোন কোন পরিবারে স্ত্রী, কন্যাকে বাধ্যতামূলক পতিতাবৃত্তিতে অংশগ্রহণ করায়।
৮. নারীনির্যাতন : বাংলাদেশ নারীনির্যাতনের দিক থেকে পৃথিবীতে দ্বিতীয় (বা প্রথম)। যৌতুকের দাবিতে বা পারিবারিক কলহের কারণে মেয়েরা পারিবারিক জীবনের প্রতি মোহ হারিয়ে ফেলে। নির্যাতিত মেয়েরা পরিবারের বাইরে গিয়ে পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে।
৯. প্রেমে ব্যর্থতা : মানুষের স্বাভাবিক যৌন প্রবৃত্তি প্রেমপ্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করে। বাঙালি মেয়েরা সাধারণত স্বামীভক্ত। তারা প্রেম ভালোবাসার উপর বিশ্বাস করে সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখে। এ পবিত্র প্রেমে যখন ব্যর্থতা বা প্রতারণার শিকার হয়ে সতীত্ব নষ্ট তখন তারা মনের জোর হারিয়ে পতিতালয়ে আশ্রয় নেয়।
১০. উন্নত জীবনের মোহ : অনেক শিক্ষিত মেয়ে উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় নিজেদের দেহের বিনিময়ে অর্থোপার্জন করে। তারা অত্যন্ত গোপনে পরপুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হয়ে যায়। রাজধানী শহরে গ্রামের সাধারণ পরিবারের মেয়েরা পড়াশোনা করতে এসে অতি অল্পদিনের মধ্যে এভাবে অর্থোপার্জনের মাধ্যমে চাকচিক্য জীবনধারা গড়ে তোলে ।
১১. প্রাকৃতিক দুর্যোগ : বাংলাদেশ সম্প্রতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মুহূর্তের মধ্যে মানুষের সাজানো গোছানো স্বপ্নের সংসার বা বাগান ভেঙে দিতে পারে। সবকিছু হারিয়ে মানুষের খোলা আকাশের তারা গণনা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। সহায়সম্বলহীন মানুষ দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে।
১২. সামাজিক নিরাপত্তার অভাব : আমাদের সমাজে মেয়েদের পান থেকে চুন খসলেই আর রেহাই থাকে না। একইভাবে সমাজে মেয়েদের হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি প্রায় অনিশ্চিত। কোন কারণে একটি মেয়ে বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে পড়লে সমাজ তাকে আর গ্রহণ করতে চায় না। বিবাহ পূর্ববর্তী যৌন সঙ্গমে নারী অংশগ্রহণ করলে তাকে সমাজচ্যুত করে ।
১৩. নিম্ন বেতন : শহরই পতিতাবৃত্তির ধারক ও বাহক। শহরের নিম্নআয়ের লোকেরা গ্রামে তাদের স্ত্রীদের রেখে আসে। ফলে যৌন চাহিদা মিটানোর জন্য মানুষ পতিতাদের নিকট গমন করে। এভাবে নিম্নআয়ের লোকেরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পতিতাবৃত্তিকে টিকিয়ে রাখছে।
১৪. পর্যটন ও ভ্রমণ : দেশে আগত বিদেশি পর্যটক ও দেশি পর্যটকরা বিভিন্ন স্থানে (বিশেষত শহরে) হোটেল ও মোটেলে আশ্রয় গ্রহণ করে। তারা শয্যাসঙ্গিনীর প্রয়োজন অনুভব করে। এভাবে পর্যটকরা পতিতাবৃত্তিকে টিকিয়ে রাখছে।
১৫. নারী পাচার : বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক নারী পাচারের শিকার হচ্ছে। অনেক নারী স্বেচ্ছায় পাচারকারীদের সংস্পর্শে গমন করছে। এসব নারী দেশে অনেক অর্থসম্পদ নিয়ে আসলেও সমাজ তাদেরকে বিদেশ ফেরত পতিতা হিসেবেই চিহ্নিত করে। তারা সমাজে কোন স্থান না পেয়ে পুনরায় (বিদেশের ন্যায়) পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে।
১৬. যৌতুক : আমাদের সমাজে বিবাহ ও যৌতুক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। অনেক পুরুষই নিছক যৌতুকের লোভে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। বিবাহের সাথে যৌতুকের সম্পর্ক থাক বা না থাক বিবাহের পর পাত্রপক্ষের যৌতুকের দাবি মিটাতে ব্যর্থ স্ত্রীকে মারপিট করে, দৈহিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে, তালাক দেয়, বিচ্ছেদ ঘটায়।
কোন আশ্রয় সমাজে নারীর জন্য থাকে না। তারা শেষে “পতিতাবৃত্তিই গ্রহণ করে।
১৭. সত্মা : বিভিন্ন কারণে আমাদের সমাজে দ্বিতীয় বা ততোধিক বিবাহের রীতি প্রচলিত আছে। সত্মার অকথ্য নির্যাতন, নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মেয়েরা পতিতালয়ে আশ্রয় নেয়। অনেক সময় সত্মা পতিতালয়ের: দালালদের নিকট সতীনের কন্যা বিক্রি করে দেয়।
১৮. অসৎ সঙ্গ : শহরের বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের কিছু মেয়েরা পতিতাবৃত্তির সাথে জড়িত। ঢাকা শহরের বিভিন্ন হোটেল ও পতিতালয়ে পুলিশ অভিযান চালিয়ে যে তথ্য দিয়েছে, সেখানে দেখান হয়েছে পতিতাদের একটা বড় অংশ হলো ইডেন কলেজ, বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুলের মেয়েরা। তাদের সংস্পর্শে যারা থাকে, তারাও এক সময় পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে।
১৯. মানসিক বিকৃতি : অনেক নারীই তাদের সতীত্ব হারিয়ে প্রতিশোধকামী হয়ে উঠে। এছাড়া একাধিক পুরুষের সংসর্গে থাকার মানসিক বিকৃতি ঘটলে নারী পতিতালয়ে দেহরঞ্জন করে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশে নানাভাবে পতিতাবৃত্তির ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পতিতাবৃত্তি সমাজে আদিকাল থেকে চলে আসলেও মানুষ একে স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে পারছে না বা করতে চায় না। সমাজে পতিতাবৃত্তির ক্ষতিকর বহুবিধ প্রভাব থাকলেও সমাজই একে টিকিয়ে রাখছে। কিন্তু এ বৃত্তিকে যত শীঘ্র সম্ভব নির্মূল করা প্রয়োজন। তবেই সমাজ কিছু কিছু দিক থেকে সুশৃঙ্খল থাকবে আশা করা যায়।