অথবা, বাংলাদেশে নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের তত্ত্বগত দিকটি আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের তাত্ত্বিক বিবরণ তুলে ধর।
অথবা, নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের তাত্ত্বিক অবস্থান লিখ।
অথবা, বাংলাদেশে নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের তত্ত্বগুলো উল্লেখ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের ধারায় ‘নারীর উন্নয়ন’ বা উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ এক অবিচ্ছেদ্য হয়েছে অনুষঙ্গ। উন্নত বিশ্বে যখন পরিকল্পনা স্তরটি অতিক্রমের পর উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ দ্বারা নারীর উন্নয়ন নিশ্চি যে বিশ্বস্বীকৃত তত্ত্ব রয়েছে তার যথাযথ প্রয়োগও এখানে ঘটছে না। এ আচ্ছন্নতা বা ধারাবাহিকতার বিচ্ছিন্নতার মূল উন্নয়নশীল দেশগুলো তখনো এ দু’স্তরে ধারাবাহিকতার অস্পষ্টতা ধূম্রজালে আচ্ছন্ন। এমনকি উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণের ক্রিয়াশীল রয়েছে দুটি বিষয়। যথা : নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকরূপে অবলোকনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং নারীকে মূলধন কর মুনাফা অর্জনের প্রবণতা। এ মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নিজেই একটি বড় ভূমিকা পালন করে।
নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের তাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিত : মানবজাতির ইতিহাস হচ্ছে নারীর উপর পুরুষের ক্রমাগত পীড়ন ও বলপ্রয়োগের ইতিহাস, যার লক্ষ্য নারীর উপর পুরুষের একচ্ছত্র স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা। সম্ভবত মানবজাতি সমগ্র ইতিহাস নয়, বরং পিতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকেই শুরু হয় নারীর উপর পুরুষের স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস নিম্নে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেয়া হলো :
১. পুরুষতন্ত্র ও লিঙ্গ বৈষম্যের ধারণা : পুরুষতন্ত্র এবং লিঙ্গ বৈষম্যের ধারণা পুরুষকে দান করেছে শ্রেষ্ঠত্ব, তাত উদ্ভব ঘটিয়েছে লিঙ্গ বৈষম্যভিত্তিক শ্রমবিভাজন অথবা উল্টোভাবে এ লিঙ্গ বৈষম্যের ধারণাই হয়ত বা সৃষ্টি করেছে ভিন্ প্ররোচিত করেছে নারী ও পুরুষের জন্য ভিন্ন পরিমণ্ডলের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত ও লালন করতে। এ ভিন্ন পরিমণ্ডলের ধারণা পরিমণ্ডলের আওতাধীন বৈষম্যমূলক শ্রমবিভাজনের নীতিমালা। যেভাবেই দেখা হোক, এ লিঙ্গ বৈষম্যমূলক শ্রমবিভাজ হলো নারীর ক্ষমতাচ্যুতির জন্য পুরুষের ছুড়ে দেয়া প্রথম অস্ত্র।
২. নারীর ভোটাধিকার দাবি : নারী আন্দোলনের প্রথম সূত্রপাত ঘটে ১৮৫৭ সালের মার্চে, যে দিনটি বর্তমানে সার পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। ঐদিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের নারী শ্রমিকরা সমঅধিকারে দাবিতে প্রথম রাস্তায় নামে। এরই সূত্র ধরে নারীর ভোটাধিকার দাবির আন্দোলনের মুখে ১৯১৩ সালের ১২ জুন নারীবাদী
নেত্রী এমিলি ওয়াইল্ডিং ডেভিসন নিহত হন।
৩. উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ : ভারতীয় নারীরা ভোটাধিকার লাভ করে ১৯২১ সালে। এ ভোটাধিকার রাজনৈতি ক্ষেত্রে নারীদের পদচারণার দ্বার খুলে দেয়। ১৯৬০ সাল হতে নারীরা সরকার প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণেও সক্ষম হতে থাকে চিরায়ত গণ্ডির বাইরে যখন নারীর পদচারণা শুরু হলো, তখনই উদ্ভব ঘটলো উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ এর প্রত্যয়টি, যা Women in Development বা WID নামে পরিচিত। এর ৫টি এপ্রোচ রয়েছে-
ক. কল্যাণমূলক এপ্রোচ : ১৯৫০-৬০ এর দশকে উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রটি ছিল ভালো ‘স্ত্রী’ বা ভালো ‘মা’ রূপে নারীকে গড়ে তোলার মধ্যে সীমাবদ্ধ, যে মা উৎকৃষ্ট নাগরিকের জন্ম দিয়ে সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখত পারে। এ সময় পরিবার পরিকল্পনা, সেনিটেশন ইত্যাদি বিষয়ে নারীকে দক্ষ করে তোলার পদক্ষেপ নেয়া হয়।
খ. সমধর্মী এপ্রোচ : ১৯৭৫-৮৫ সময়কালে, অর্থাৎ জাতিসংঘ ঘোষিত নারী দশকে এ প্রত্যয়টি জোরদার হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের বিভিন্ন অধিবেশনে নারীর সমঅধিকারের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে উপস্থাপিত
হতে থাকে এবং ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয় নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণ ও তার দক্ষতায়নের
সনদ সিডও। এটি ছিল নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ সনদ।
গ. দক্ষতা এপ্রোচ : ১৯৮০-৯০ এর দশকে অধিক গুরুত্বারোপ করা হয় নারীর ক্ষমতা বৃদ্ধির উপর, যাকে মূলতনারীর উন্নয়ন বলা চলে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিক্ষা, চাকরি, রাজনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীদের জন্য আলাদা কোটা ওবিশেষ বিশেষ সুযোগ সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হয় ।
ঘ. দারিদ্র্য বিমোচন এপ্রোচ : সময়ের দাবি ও কালের বিবর্তনে উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণের ধারা ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রতিভাত হতে থাকে। দারিদ্র্য বিমোচন এপ্রোচ তেমনি একটি ধারা। এটি গত শতাব্দীর আশির দশক হতে শুরু হয়। এ কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে নারীদের মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ ও তাদের কর্মসংস্থানের যোগান দিয়ে জাতীয় দারিদ্র্য দূরীকরণ আন্দোলনে নারীদের সম্পৃক্ত করা।
ঙ. ক্ষমতায়ন এপ্রোচ : বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক হতে এ এপ্রোচটি জোরদার হয়ে উঠে। এ তত্ত্বের সারকথা হচ্ছে নারীকে কেবল অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলাই যথেষ্ট নয়, বরং জীবনের সকল পর্যায়ে তার নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন ঘটানো এবং নিজের জীবনকে অন্যের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখার শক্তি অর্জনের যোগ্যতা সৃষ্টিতে সহায়তা করা। একেই এক কথায় বলা হয় ক্ষমতায়ন। নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি নব্বইয়ের দশক হতে নারী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, নারী আন্দোলনের কাঙ্ক্ষিত ও প্রত্যাশিত ফল হচ্ছে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন। নারীর আন্দোলন তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু এ আন্দোলনের প্রাপ্য ফলভোগ হতে নারীরা আজও বঞ্চিত। এখনো নারীর উন্নয়ন বা উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণের জন্য যে কর্মসূচিগুলো গৃহীত হচ্ছে, তার অধিকাংশের ব্যবস্থাপনায় ও নীতিনির্ধারণে রয়েছে পুরুষতন্ত্রের ধারক পুরুষরাই। এ কারণে নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন শব্দ দুটি প্রকল্পের অন্যান্য কর্মসূচির মতো একটি বিচ্ছিন্ন কর্মসূচি বা কর্মসূচির অংশ হিসেবে থেকে গেছে। বিভিন্ন প্রকল্পগুলো নারী উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, মনিটরিংয়ের অন্যতম বিষয় হওয়া উচিত এগুলোর বাস্তবায়ন কতটুকু হচ্ছে তার জবাবদিহিতা থাকা।