অথবা, বাংলাদেশে নারীদের সমস্যা সমাধানে সমাজকর্মীর ভূমিকা কী হওয়া উচিত?
উত্তর৷ ভূমিকা : সমাজকর্ম হল একই সাথে একটি কলা, বিজ্ঞান ও পেশা, যা কতকগুলো পদ্ধতি ব্যবহার করে এবং কতিপয় মূল্যবোধকে অবধারণ করে ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যার প্রতিকার, প্রতিরোধ ও উন্নয়নে প্রচেষ্টা চালায়।
বাংলাদেশে নারীদের সমস্যা একটি পুরাতন/ঐতিহাসিক সমস্যা এবং বাংলাদেশে সমাজকর্মের অনুশীলন তুলনামূলকভাবে স্বল্প দিনের। তার উপরে পেশাদার সমাজকর্মের প্রয়োগ ও অনুশীলন এখানে তেমন একটা দেখা যায় না। তারপরেও সমাজকর্মের একজন ছাত্র হিসেবে বাংলাদেশে নারীদের সমস্যা সমাধানের জন্য করণীয় দিকগুলো সম্পর্কে নিম্নে আলোকপাত করছি।
সমাজকর্মীর ভূমিকা : সমাজকর্মের আলোচ্যবিষয়ের মধ্যে নারীকল্যাণ একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে আছে। সমাজকর্ম বিশ্বাস করে মানুষের সমঅধিকার ও সমমর্যাদায়। এখানে মানুষকে নারী-পুরুষ বলে কোনরূপ বৈষম্য দেখানোর প্রবণতা সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। সমাজকর্মী যে কোন কর্মসম্পাদনে প্রথমত কতিপয় সাধারণ কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকেন। যেমন- Study, research, policy, formulation, programe planning, implementation
ইত্যাদি। এসব কর্ম করার সাথে সাথে এদেশে নারীকল্যাণের জন্য সমাজকর্মী যেসব বিশেষ বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে তা নিম্নরূপ :
১. চাহিদা ও প্রয়োজন নির্ধারণে সহায়তা : বাংলাদেশের অধিকাংশ নারীই তাদের নিজেদের চাহিদা ও প্রয়োজনসমূহ কি তা জানে না। কারণ তারা অশিক্ষিত, অসচেতন এবং অজ্ঞ। ফলে দেখা যায় পরিবার ও সমাজের কাছ থেকে তারা
যেটুকু সুযোগ সুবিধা ও অধিকার পায় তাই নিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কিন্তু তারা যদি তাদের চাহিদা ও প্রয়োজনগুলো সম্পর্কে জানত তবে তারা তা আদায়ের জন্য সচেষ্ট হতে পারত। সুতরাং এক্ষেত্রে সমাজকর্মী এদেশের নারীদেরকে তাদের কি কি চাহিদা ও প্রয়োজন রয়েছে তা অবহিত হতে সহায়তা করতে পারেন।
২. সম্পদের সদ্ব্যবহার : কোন মানুষই একেবারে সম্পদহীন নয়। একটি মানুষের মধ্যে বস্তুগত এবং অবস্তুগত কিছু সম্পদ ও সামর্থ্য থাকে এবং পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে ব্যক্তি কিছু সম্পদ প্রাপ্তির দাবিদার। তাই সমাজকর্মী আমাদের নারী সম্প্রদায়কে তাদের জন্য প্রাপ্ত সম্পদ প্রাপ্তিতে এবং তা তাদের কাজে লাগাতে সহায়তা করতে পারেন, যাতে তারা তাদের সম্পদের সর্বোত্তম সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে।
৩. নারীদের সমস্যা ও কর্ম সম্পর্কে জানা : নারী সমাজের মধ্যে চাহিদা ও প্রয়োজনের অপূরণজনিত অবস্থা থেকে বহুবিধ সমস্যা সৃষ্টি হয় । সবসময় এ সমস্যার প্রভাব সঠিকভাবে Measure করা পরিবার কিংবা সমাজের পক্ষে সম্ভব নয়।ফলে উক্ত সমস্যা সমাজে মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং সামাজিক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়। তাই আমাদের দেশে সমাজকর্মী নারী সম্প্রদায় ও তাদের অভিভাবকদের সাথে মিশে তাদের সমস্যা ও কর্ম সম্পর্কে অবগত হয়ে করণীয় সম্পাদনে নির্দেশনা দানে সহায়তা দিতে পারেন।
৪. আত্মনিয়ন্ত্রণে সহায়তা : ব্যক্তির যখন তার নিজস্ব চিন্তাচেতনা ও কর্মকাণ্ডের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকে তখন উক্ত ব্যক্তিকে একজন আত্মনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। আত্মনিয়ন্ত্রণের মূলকথা হল নিজের শক্তি ও সামর্থ্যের দ্বারা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা, চিন্তা ও কর্মে অন্যের উপর নির্ভরশীল না হওয়া। আমাদের দেশে নারীদের নিজেদের ভবিষ্যৎ কল্যাণে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণে সহায়তা দানে সমাজকর্মী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
৫. বন্ধু/সঙ্গ/দল গঠনে সহায়তা : ব্যক্তির আচরণে তার বন্ধুবান্ধব তথা Peer group এর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’ তাই দেখা যায়, তরুণ সমাজ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসৎ বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে চুরি, ডাকাতি, নেশা করা, মাদকাসক্ত হওয়া, খুন, ছিনতাই ইত্যাদি নানাবিধ অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। তাই আমাদের নারীদের উক্ত সমস্যা থেকে দূরে রাখার জন্য তাদের বন্ধু নির্বাচনে সমাজকর্মী সহায়তা করতে পারেন।
৬. উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে সহায়তা : বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, মানবহিতৈশী দর্শন, পেশাগত দক্ষতা ও মূল্যবোধভিত্তিক একটি সেবাকর্ম হিসেবে সমাজকর্ম মানুষের সমস্যা সমাধানে/মোকাবিলায় কাজ করে চলছে। সমাজকর্মে বিশ্বাস করা হয় যাদের জন্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। কারণ অংশগ্রহণের মাধ্যমে উভয়পক্ষ উভয়পক্ষকে জানতে পারে। ফলে আদানপ্রদান তুলনামূলক সহজ হয়। তাই আমাদের নারীদের বিভিন্ন ধরনের সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সমাজকর্মী সহায়তা করতে পারেন।
৭. নেতৃত্বের বিকাশ সাধন : নেতৃত্ব হল ব্যক্তির এমন এক বা একাধিক গুণাবলির সমষ্টি যে গুণাবলি সে স্বীয় অধ্যবসায় বা উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করে এবং এ গুণাবলিসম্পন্ন হওয়ার ফলে সমাজের অন্যান্য ব্যক্তি তাকে মেনে চলে।আমাদের নারী সমাজের মধ্যে আজ নেতৃত্বের খুব অভাব। ফলে তারা সঠিক নির্দেশনা পাচ্ছে না এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে সঠিক পথে এগুতে পারছে না। সুতরাং নারী সমাজের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলির সঞ্চার ও তার বিকাশ সাধনে সমাজকর্মী সাহায্য দিতে পারেন।
৮. পারিবারিক জীবন শিক্ষা : আমাদের নারী সমাজ পারিবারিক জীবন শিক্ষা সম্পর্কে তেমন একটা জানার সুযোগ পায় না। ফলে দেখা যায় তারা পারিবারিক জীবনে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়। সুষ্ঠু পরিবার ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ হয়।পারিবারিক দায়িত্ব যথার্থভাবে পালন করতে পারে না। বাবা-মা হিসেবে তারা নিজেদের উপযুক্ত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়।সমাজকর্মী আমাদের নারী সমাজকে পারিবারিক জীবন শিক্ষার মাধ্যমে তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে উপযুক্ত বাবা-মা হয়ে গড়ে উঠতে সহায়তা দিতে পারেন।
৯. নৈতিকতাবোধ সৃষ্টি : নৈতিকতাবোধ সৃষ্টি ও তার অনুশীলনে সমাজকর্মী আমাদের দেশের নারীদের সাহায্য করতে পারেন। কারণ নৈতিক শিক্ষা মানুষের জীবনে অত্যন্ত জরুরি। নৈতিকতার সাথে মানুষের বিবেক ও বিবেচনার গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। এর ফলে নারীরা সত্য মিথ্যা, উচিৎ অনুচিৎ, ভালোমন্দ ইত্যাদি বিচার বিবেচনার সামর্থ্য অর্জনে সক্ষম হবে।
১০. সংশোধনের ক্ষেত্রে সহায়তা : আমাদের দেশে নারীরা তাদের চাহিদা পূরণ না হওয়ার ফলে নানাবিধ অপরাধ কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। এসব অপরাধীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশই দেখা যায় অভাবের তাড়নায় জীবনের
প্রয়োজনে অপরাধ কর্মে নিয়োজিত হয়। তাই এদেরকে সংশোধনের মাধ্যমে সমাজে পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে সমাজকর্মী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। কারণ সমাজকর্মে মানুষের শাস্তির চেয়ে তাকে সংশোধনের উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, নারীদের সমস্যা শুধুমাত্র নারীসমাজের একক সমস্যা হিসেবে প্রত্যক্ষ করলে চলবে না। কারণ নারীরা আমাদের সমাজেরই একটা অংশ। সমাজে তাদের মর্যাদা ও অবদান কখনও মা, কখনও স্ত্রী, আবার কখনও বা কন্যারূপে। আর তাই এ মা, স্ত্রী, কন্যা এদের সমস্যার সমাধান যদি না করা হয় তবে সমাজ তথা রাষ্ট্রের উন্নয়ন ব্যাহত হবে।