অথবা, বাংলাদেশে নারীদের প্রধান প্রধান সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে এগুলো সমাধানের পন্থা বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে নারীদের সমস্যাগুলো কী কী? সমস্যাগুলো সমাধানের কৌশল বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে নারীদের সমস্যাগুলো উল্লেখ কর। এগুলো সমাধানের মাধ্যমসমূহ বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : একটি সমাজ তথা রাষ্ট্রের মোট জনসমষ্টির প্রায় অর্ধেক হল নারী। যে সমাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমান যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকে ঐ সমাজের অগ্রগতি ও উন্নতি স্বাভাবিকভাবেই বেশি হয়। সমাজে তাই নারীকে গুরুত্ব না দিয়ে নারীর সমস্যার সমাধান না করে শুধুমাত্র পুরুষের সমস্যার উপর গুরুত্ব দিলে সমাজে কখনই ভারসাম্যপূর্ণ এবং সুষম উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই নারীর সমস্যা এবং তা মোকাবিলাকরণের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় কর্মসূচি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
বাংলাদেশে নারীদের প্রধান প্রধান সমস্যা : তৃতীয় বিশ্বের (মতান্তরে চতুর্থ বিশ্বের) একটি দেশ হিসেবে জনসংখ্যাবহুল এই বাংলাদেশের সমাজে বহুবিধ সমস্যা বিদ্যমান। এক্ষেত্রে নারীসমাজের অবস্থা পুরুষের তুলনায় আরও করুণ। আমাদের দেশের নারীদের প্রধান প্রধান সমস্যাগুলো নিতে আলোচনা করা হল :
১. দারিদ্র্য : বাংলাদেশের নারীদের একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা হল দারিদ্র্য। দারিদ্র্য হল এমন একটি নেতিবাচক অর্থনৈতিক অবস্থা যে অবস্থায় একজন মানুষ/ব্যক্তির আয় অত্যন্ত কম থাকে। ফলে সে তার মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে সমর্থ হয় না। যেমন- জাতিসংঘের মতে, ঐ ব্যক্তি হল দরিদ্র যার দৈনিক আয় ১ ডলারের কম। ২০০০ সাল নাগাদ সামাদের দেশে চরম দারিদ্র্য ১৯.৯৮ এবং অনপেক্ষ দারিদ্র্য ৪৪.৩০%।
২. বেকারত্ব : নারীদের কর্মসংস্থান লাভের চাহিদা পূরণ না হওয়ার ফলে বেকারত্ব সমস্যা সৃষ্টি হয়। বেকারত্ব হল ব্যক্তির এমন একটি অবস্থা যে অবস্থায় ব্যক্তি কাজ করতে সক্ষম থাকে অথচ কাজ পায় না। তাই বলা যায়, আমাদের দেশে বেকারত্ব নারীদের অন্যতম প্রধান সমস্যা।
৩. নিরাপত্তাহীনতা : দেশের শিক্ষিত, অশিক্ষিত সব নারীদের জন্যই এ সমস্যাটি বিদ্যমান। নিরাপত্তার মূলকথা হল যখন ব্যক্তি প্রতিকূল আর্থসামাজিক অবস্থায় থাকবে তখন তাকে সমাজ বা রাষ্ট্র কর্তৃক Support দেয়া। কিন্তু আমাদের দেশে নারীদের জন্য এ ধরনের কোন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা যেমন- বেকারভাতা, বৃত্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা, নারী কল্যাণ কার্যক্রম ইত্যাদি এক প্রকার নেই বললেই চলে।
৪. নিরক্ষরতা : সকল শ্রেণীর নারীদের জন্য নিরক্ষরতা একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। সাধারণত নিরক্ষরতা বলতে বুঝায় অক্ষরজ্ঞানহীন অবস্থা। বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ঐ ব্যক্তি নিরক্ষর যে কোন ভাষায় চিঠি লিখতে ও পড়তে অক্ষম। আমাদের মোট জনসাধারণের ৬২.৬৬% শিক্ষিত (সমীক্ষা-২০০৩)। সুতরাং দেখা যায় আমাদের নারী সমাজের একটা অংশ বর্তমানে নিরক্ষর, যা সমগ্র দেশ ও জাতির জন্য সমস্যা।
৫. স্বাস্থ্যহীনতা : রোগমুক্ত সুস্থ শরীরকেই বলা হয় স্বাস্থ্য। আমাদের নারী সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বাস্থ্যহীনতা সুস্বাস্থ্যের অভাব অনেক বেশি। বিশেষ করে অশিক্ষিত ও দরিদ্রদের জন্য এটি একটি প্রধান সমস্যা। তারা বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। যথাযথ চিকিৎসা ও সেবা না পাওয়া এবং পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে স্বাস্থ্যহীনতা সমস্যায় তারা আক্রান্ত হচ্ছে।
৬. মাদকাসক্তি : সমগ্র বিশ্বেই মাদকাসক্তি একটি ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা। তবে এখানে পুরুষদের সংখ্যাই এই সময় বেশি ছিল। কিন্তু বর্তমানে নারীদের সংখ্যাও আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারীদের চাহিদা ও প্রয়োজন সঠিকভাবে পূরণ না হওয়ার ফলে সামাজিকভাবে অবহেলা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে তারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে উন্নত দেশের সমাজগুলোতে নারীদের মধ্যে মাদকসক্তির প্রবণতা উন্নয়নশীল দেশগুলোর চেয়ে বেশি।
৭. সামাজিক বৈষম্য : আমাদের সমাজে নারী ও পুরুষের মাঝে বৈষম্য বিদ্যমান। চিন্তায়, কর্মে, শিক্ষায়, খেলাধুলায়, রাজনীতিসহ সকল ক্ষেত্রে নারীদেরকে পুরুষের সমান সুযোগ প্রদান করা হয় না। তাই নারীদের যে এসব কর্ম করার যোগ্যতা ও সামর্থ্য আছে এর স্বীকৃতি দিতে হবে।
৮. নারী নির্যাতন : নারীদের চাহিদা পূরণ না হওয়ার ফলে সমাজে নারী নির্যাতনজনিত সামাজিক সমস্যা নাই আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে- তালাক, বিচ্ছেদ, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা, এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ বা বলাৎকার, খুন ইত্যাদি। মূলত নারীর সরলতা ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নারীর উপর এ ধরনের অমানবিক নির্যাতন নি চালানো হয়। এ ধরনের নির্যাতনের ফলে নারীরা দৈহিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে পঙ্গুত্বের শিকার হয়।
১. দারিদ্র্য দূরীকরণ : আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০% দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। সেখানে নারীদের অবস্থা আরও শোচনীয়। তাই নারীদের দারিদ্র্য দূরীকরণের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ নারীর দারিদ্র্যজনিত সমস্যা আরও অনেক অনেক সমস্যার জন্ম দেয়। দারিদ্র্যের ফলে নারীরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে । সুতরাং নারীদেরকে দারিদ্র্য অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের উদ্দেশ্য গ্রহণ করতে হবে।
২. ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি : আমাদের দেশের নারীরা সাধারণত গৃহকর্ম সম্পাদন করে থাকে। ফলে দেখা যায় গৃহকর্ম সম্পাদনের পর তাদের হাতে প্রচুর সময় থেকে যায়। পরিবারের এসব গৃহিণী শিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত তরুণী ও যুবতীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তাদেরকে তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী বিভিন্ন কর্মে প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে। এজন্য তাদের সহজ শর্তে ঋণদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে৷
৯. পাচার ও চোরাচালান বৃদ্ধি : নারীর চাহিদা যথাযথ উপায়ে পূরণ হয় না বলে সমাজে নারী এবং মেয়ে শিশুদের এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাচারের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। পাচারকৃত নারীদের বাধ্য করে নিয়োজিত করা হয় পতিতাবৃত্তিতে। আবার নারীরা অনেক সময় নিজেদের চাহিদা অপূরণজনিত কারণে নিয়োজিত হয় চোরাচালানজনিত কর্মকাণ্ডে। তারা মাদকদ্রব্য, স্বর্ণ, আগ্নেয়াস্ত্র পাচার কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে।
৩. নিরক্ষরতা দূরীকরণ : আমাদের দেশের নারীদের নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে হবে। তাদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। ফলে তারা নিজেকে ও নিজের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে শিখবে। তাদের
মধ্যে নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে। অন্যের কুমন্ত্রে সে পরিচালিত না হয়ে নিজে নিজেকে পরিচালিত করতে সক্ষম হবে।এজন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা, যুব শিক্ষাদান কর্মসূচি প্রবর্তন করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে নারীদের সমস্যা সমাধানের উপায় : বাংলাদেশে নারীদের সমস্যা মূলত একটি ঐতিহাসিক/প্রাচীন/ পুরাতন সমস্যা। তবে উক্ত সমস্যা সমাধানের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ অনুসরণ করা যেতে পারে। যেমন-
৪. স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ : স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। রুগ্ন ও অসুস্থ ব্যক্তি নিজের জন্য এমনকি সমাজের জন্যও বোঝা/সমস্যা। আমাদের নারী শক্তিকে উন্নয়নের পথে ধাবিত করতে হলে তাদের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার বিষয়টি অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের জন্য যুব স্বাস্থ্য কেন্দ্র অথবা হাসপাতালগুলোতে নারী কর্নার স্থাপন করে তাদের স্বাস্থ্যসেবা দান কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। জাতীয় উৎপাদন ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য যুবকদের কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান
একান্ত অপরিহার্য।
৫. পতিতাবৃত্তি রোধ : সকল দেশের সকল সমাজে পতিতাবৃত্তি একটি ঘৃণ্য পেশা। কিন্তু তারপরেও শতশত ধরে সমাজে এ কুপ্রথা টিকে আছে। আমাদের দেশের নারীসমাজকে পতিতাবৃত্তির মত এ অবমাননাকর পেশা থেকে দিতে হবে। এজন্য প্রথমত সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আইন রক্ষাকারী বাহিনীকে এজন্য ব্যবহার করা যেতে বছর পারে। তাছাড়া এসব পতিতালয়ে কর্মরত পতিতাদেরকে সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
৬. সুস্থ চিত্তবিনোদন : সব চিত্তবিনোদনই যে সুস্থ ধারার তা কিন্তু নয়। অনেক ধরনের বিনোদন ব্যবস্থা আছে, যা নারীদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা সৃষ্টিতে সহায়তা করে। এসব বিনোদন পরিহার করতে হবে। তাদেরকে সম্পৃক্ত করতে হবে গঠনমূলক ও ইতিবাচক বিনোদন কর্মকাণ্ডের সাথে। এজন্য জাতীয় উদ্যোগে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা প্রতিযোগিতা আয়োজন ও পরিচালনা, পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে প্রতিভার মূল্যায়ন ইত্যাদি কার্যক্রম সম্পন্ন করা যেতে পারে।
৭. মাদকাসক্তি দূরীকরণ/নিরাময় : মাদকাসক্তিজনিত সমস্যা আমাদের দেশে নারীদের ক্ষেত্রে প্রধানত শহুরে ধনী পরিবার এবং বস্তিতে থাকা দরিদ্র পরিবারগুলোতে তুলনামূলক বেশি দেখা যায়। মাদকের নেতিবাচক প্রভাব পুরুষদের তুলনায় নারীদের উপর বেশি মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়। মাদকের প্রভাবে মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে ক্রমশ দূরে সরে যায়, তার শরীরে অবসাদগ্রস্ততা চলে আসে এবং আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ে। তাই এক্ষেত্রে নারীদের জন্য পারিবারিকভাবে পরিবারের সকল সদস্যকে মাদকের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করা, মাদকের সহজলভ্যতা রোধ করা ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে।
৮. নারী নির্যাতন রোধ : আমাদের দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নারী নির্যাতন রোধ করতে হবে। যেসব পরিবারে নারী নির্যাতনের হার বেশি ঐসব পরিবারের সন্তানরা হতাশা, উদ্বিগ্নতা ও হীনম্মন্যতায় ভোগে। আবার দেখা যায়, মা-বাবার মধ্যে ঝগড়াঝাটি, মারামারির ফলে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ে। সুতরাং নারী নির্যাতন রোধের জন্য সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যৌতুকের মত কুপ্রথাকে পরিহার করতে হবে।
৯. সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ : আমাদের দেশে অপরাধীদেরকে যথাযথভাবে সামাজিকীকরণ করতে হবে। এজন্য জন্মের পর থেকে পরিবার তাদের সামাজিকীকরণে সহায়তা প্রদান করবে। নারীদেরকে সামাজিক রীতিনীতি, প্রথাপ্রতিষ্ঠান, আদর্শ মূল্যবোধ ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে। প্রয়োজনে তাদেরকে প্রচলিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের ভাবধারা থেকে সরিয়ে উন্নত ও আধুনিক সমাজের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশে নারীদের সমস্যা একটি ঐতিহাসিক/প্রাচীন সমস্যা, যে সমস্যার সূত্রপাত একদিনে হয় নি। পুরুষ শাসিত এদেশের সমাজব্যবস্থায় তাই দেখা যায় নারীর চাহিদা ও প্রয়োজন যুগে যুগে উপেক্ষিত ও অপূরণীয় থেকে গেছে। কিন্তু বর্তমানে পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় পুরুষের পাশাপাশি নারীসমাজের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে উপলব্ধির ক্ষেত্রে বিশ্ব অনেক এগিয়ে গিয়েছে।