প্রশ্নঃ বাংলাদেশে কৃষি আধুনিকীকরণের উপায়সমূহ আলোচনা কর ।
উত্তরা ভূমিকা : বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধানদেশ । কৃষি প্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষির উপর নির্ভরশীল । কাজেই কৃষির আধুনিকীকরণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ অর্জন সম্ভব ।
বাংলাদেশে কৃষি আধুনিকীকরণের উপায়সমূহ : বাংলাদেশে কৃষি আধুনিকীকরণ ত্বরান্বিত করতে হলে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা যেতে পারে।
১. কৃষি ঋণের পর্যাপ্ত যোগান : আমাদের দেশের কৃষকেরা অত্যন্ত দরিদ্র । তাই তারা কৃষিক্ষেত্রে দামি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারে না । অতএব এদেশে কৃষির আধুনিকীকরণের মাধ্যমে কৃষি ও কৃষকের অবস্থা ত্বরান্বিত করতে হলে ঋণের পর্যাপ্ত যোগান নিশ্চিত করতে হবে । :
২. কৃষি যন্ত্রপাতির উৎপাদন : কৃষির আধুনিকীকরণের জন্য বিদেশ থেকে যন্ত্র আমদানি করে এদেশের কৃষিতে যান্ত্রিক চাষাবাদ পদ্ধতি প্রবর্তন করা সম্ভব নয় । সুতরাং আধুনিক যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ চালাতে হলে প্রয়োজনীয় কৃষি যন্ত্রপাতি দেশের অভ্যন্তরেই উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে ।
৩. শিক্ষার প্রসার : বাংলাদেশে কৃষি আধুনিকীকরণের পথে অন্যতম বাধা হলো কৃষকদের পর্যাপ্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব । সুতরাং নিরক্ষর কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক গণশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে । তাহলে তারা কৃষির আধুনিকায়ন সম্বন্ধে জানতে পারবে এবং কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগে উদ্যোগী হবে ।
৪. প্রকৃতির উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস : বাংলাদেশের কৃষি অধিক মাত্রায় প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল । ফলে কৃষকেরা আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ পরিচালনা করতে আগ্রহী নয় । এ অবস্থা দূর করতে হলে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করে আধুনিক পদ্ধতিতে জলসেচের ব্যবস্থা করতে হবে ।
৫. যন্ত্রপাতির মেরামত : কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার প্রচলন করতে হলে দেশের গ্রামাঞ্চলে যন্ত্রপাতি মেরামতের জন্য পর্যাপ্ত কারখানা , ওয়ার্কশপ তৈরি করতে হবে । কিন্তু বর্তমানে আমাদের গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের কারখানা নেই বললেই চলে ।
৬. কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি : আমাদের কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রয়োগ করা হলে অনেক কৃষি শ্রমিক উদ্বৃত্ত হবে এবং তারা বেকার হয়ে পড়বে । সুতরাং কৃষিতে আধুনিক পদ্ধতির মাধ্যমে কৃষি উন্নয়ন করতে হলে গ্রামাঞ্চলে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প স্থাপনের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে হবে ।
৭. সমবায় কৃষি খামার : কৃষির আধুনিকীকরণ ত্বরান্বিত করতে চাইলে সমবায় কৃষি খামারের মাধ্যমে বিভিন্ন কৃষকের জমি একত্রিত করে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যেতে পারে । এ ব্যবস্থায় সমবায়ের মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে উন্নত যন্ত্রপাতি , ভালো বীজ ও রাসায়নিক সারের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে ।
৮. যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি : কৃষির আধুনিকীকরণ সমস্যা দূর করতে হলে গ্রামাঞ্চলে যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করতে হবে । দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কৃষিকাজে ব্যবহৃত ভারী যন্ত্রপাতি , কলের লাঙল ইত্যাদি যাতে একস্থানে থেকে অন্যস্থানে সহজে আনা নেয়া করা যায় , সেজন্য আমাদের সড়কপথের ব্যাপক সংস্কার ও উন্নয়ন সাধন করতে হবে ।
৯. উত্তরাধিকার আইন সংশোধন : আমাদের দেশে জমির উপবিভাজন কৃষির আধুনিকীকরণের পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে । জমির উপবিভাজন রোধ করার উদ্দেশ্যে উত্তরাধিকার আইনের যথাযথ সংশোধন করতে পারলে কৃষির আধুনিকায়ন বৃদ্ধি করা যাবে ।
১০. পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা : কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে । সুতরাং কৃষিতে যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার আগে আমাদের কৃষি শ্রমিকদেরকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থার উদ্যোগী হওয়া দরকার ।
১১. সরকারি অনুপ্রেরণা : আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থায় কেবলমাত্র কৃষকের চেষ্টায় আধুনিক যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের প্রবর্তন করা সম্ভব নয় । সরকারের অর্থনৈতিক নীতিও এর অনুকূল হওয়া প্রয়োজন । কৃষিতে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার প্রয়োগ করে কৃষকেরা । ফলন বৃদ্ধিতে উৎসাহিত হয় , সেজন্য সরকারকে কৃষকদের মধ্যে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে হবে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে , বাংলাদেশের কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা এখনো সফল হতে পারে নি । ফলে চারটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কার্যক্রম অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের স্বপ্ন এখনো বাস্তবায়িত হয় নি । তবে কৃষির আধুনিকীকরণ তথা কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়টি একান্তভাবেই দেশের ভূমিস্বত্ব ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল । আর কৃষির আধুনিকীকরণ সম্প্রসারিত হলে দেশের কৃষি উন্নয়ন তথা সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করা সম্ভব হবে ।