বাংলাদেশে আয় বৈষম্যের কারণসমূহ আলোচনা কর।

রকেট সাজেশন
রকেট সাজেশন

অথবা, বাংলাদেশের আয়ের অসম বণ্টনের কারণ কি কি?

উত্তর : ভূমিকা: আয়ের অসমবণ্টন ধনতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য। ধনতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদনের উপাদানের মালিকানা ও তার ব্যবহারের উপর আয় নির্ভর করে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে আয়ের অসম বন্টনের কারণগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ

১. সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানাঃ সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা যেহেতু আমাদের দেশে আইন বিরুদ্ধ কাজ নয়, তাই সম্পদ মুষ্টিমের লোকের হাতে কেন্দ্রিভূত হয়। অন্যদিকে সমাজের বৃহত্তর অংশ অসহার সম্বলহীন।

২. ভূমির অসম বণ্টন: বাংলাদেশে শতকরা প্রায় ৮০ জন লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। অথচ দেশের শতকরা ৬২ ভাগ কৃষক ভূমিহীন। গ্রামীণ পরিবারে ৬২ শতাংশ মোট গ্রামীণ জমির ১৮ ভাগ। ফলে আয় বৈষম্য দেখা দেয়া স্বাভাবিক।

৩. ব্যাপক দারিদ্র্য: বাংলাদেশে আয় ও সম্পদের অসম বণ্টনের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিদ্যমান ব্যাপক দারিদ্র্যকে দায়ী করা চলে। নিম্নভোগপ্তর, নিম্ন মাথাপিছু আয় ও নিম্ন জীবন যাত্রায় অভ্যন্ত এদেশের সিংহ ভাগ লোক ক্ষুধা, অপুষ্টি, ও প্রাণসংহারকারি ব্যাধির স্বীকার।

৪. ব্যাপক বেকারত্ব : দেশে অনেক শিক্ষিত অর্ধশিক্ষত এবং অশিক্ষিত বেকার বিদ্যমান। ব্যাপক ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব বিদ্যমান থাকায়, আয় বণ্টনের ক্ষেত্রেও অসমতা সৃষ্টি হয়েছে।

৫. স্বল্প মজুরি : বাংলাদেশে ভূমিহীন ক্ষেতমজুরদের আয়ের প্রধান উপকরণ হলো শ্রম। বাংলাদেশের কৃষি ও শিল্প উভয় খতেই শ্রমের চাহিদার তুলনায় যোগান বেশি, ফলে মজুরি কম। ফলে ভূস্বামী ও পুজিপতিদের তুলনায় সাধারণ মানুষের আয় সঙ্গত কারণেই কম।

৬. একচেটিয়া ব্যবসায় ও পুঁজির প্রাধান্যঃ বাংলাদেশের এখনও স্বল্প সংখ্যক উদ্যোক্তা ও একচেটিয়া পুঁজির প্রাধান্য বিদ্যামান। দেশে সৃষ্ট সম্পদের মালিকানা ও এ শ্রেণির হাতেই কেন্দ্রিভূত রয়েছে।

৭. দ্রুত জনসখ্যা বৃদ্ধি:বাংলাদেশে শিক্ষিত ধনী পরিবারগুলোর তুলনায় অশিক্ষিত গরীর পরিবারগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অধিক। ফলে অশিক্ষিত গরীব পরিবারগুলো দিন দিন আরও গরীব হচ্ছে।

৯. প্রথা : বাংলাদেশে প্রচলিত উত্তরাধিকারী প্রথা অনুযায়ী পিতার সঞ্চিত সম্পদ তার সন্তানের উপর

৮. উত্তরাধিকারী বর্তায়: ফলে সম্পদের মালিকেরা জীবনের শুরুতেই অন্যদের তুলনায় অধিকতর সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। ফল আয় বৈষম্য সৃষ্টি হয়।

৯. শিক্ষার সুযোগ: আমাদের সমাজে সকলের জন্য শিক্ষায় এক রকম সুযোগ নেই। সমাজে ধনী শ্রেণি তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবে সুশিক্ষা লাভকরে এবং দরিদ্র শ্রেণি শিক্ষার সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে সমাজে আয় বৈষম্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।

১০. নূন্যতম মজুরি আইনের অভাব: আমাদের দেশে ন্যূনতম মজুরি আইনের থাকলেও তা কখনও বাস্তবে কার্যকর হয় না। ফলে শ্রমিক কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হয়। এতে শ্রমিক ও মালিকের আয়ের পার্থক্য ক্রমশ বাড়তে থাকে।

১১. অসম উন্নয়ন কৌশল: অতীতে বাংলাদেশের সর্বত্র সমভাবে উন্নয়নের জন্য কৌশল প্রণয়ন করা হয়নি। শাসক যে এলাকার, উন্নয়নের সিংহভাগ সে এলাকায় সম্পাদিত হয়েছে। এ অসম উন্নয়ন কৌশলের কারণ শহর কেন্দ্রিক উন্নয়ন হয়েছে। গ্রামগুলো উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

১২. দুর্নীতিঃ সামাজিক দুর্নীতি আমাদের দেশে আয় বৈষম্যের একটি অন্যতম কারণ। এদেশের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ মানুষ অসদুপায় অবলম্বন করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। ফলে দেশে আয় বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।

১৩. শ্রমিক শোষণ: বাংলাদেশের মুষ্টিমের উদ্যেক্তাগণ শিল্প কারখানার মালিক। তারা শ্রমিকদেরকে ন্যায্য মজুরি হতে বঞ্চিত করায় তারা নিম্নমানের জীবন ধারণ করে।

১৪. ব্যক্তিগত প্রতিভার তারতম্যঃ মানুষের ব্যক্তিগত প্রতিভার তারতম্য থেকেও আয়-বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। সাধারণ যে ব্যক্তি যত প্রতিভাবান তার আয় তত বেশি। এ কারণে সমাজ হতে আয় বৈষম্য সম্পূর্ণ রূপে দূর করা সম্ভব হয় না।

১৫. মুদ্রাস্ফীতিঃ মুদ্রাস্ফীতিতে শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি হ্রাস পায়। পক্ষান্তরে ব্যবসায়ীদের মুনাফা বাড়ে। বাংলাদেশে বর্তমানে চরম মুদ্রাস্ফীতি বিরাজ করছে। ফলে সমাজ আয় বৈষম্যও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

১৬. ব্যাপক সামাজিক নিরাপত্তার অভাবঃ যদিও নামে ও মাত্র বয়স্ক ভাতা, গৃহায়ণ তহবিল, কর্মসংস্থান ব্যাংক প্রকল্প, আশ্রয়ন প্রকল্প, সামাজিক নিরাপত্তামূলক প্রকল্প চালু করা হয়। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। তাই আয় বণ্টনে অসমতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।

১৭. কর ফাঁসি: বাংলাদেশে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা জনগনের মধ্যে বিরাজমান। যারা সমাজে বিত্তশালী তারা যদি সরকারকে ন্যায্য কর দিতে রাজি না থাকে তবে আয় বণ্টনে অসমতা দেখা দিবে।

১৮. পেশাগত প্রশিক্ষণ:পেশাগত প্রক্ষিক্ষণ মানুষের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করে। তবে সকল প্রশিক্ষণ হতে আয় উপজিনের সমান সুযোগ সৃষ্টি হয় না। সুতরাং প্রশিক্ষণের পার্থক্যের কারণেও সমাজে আয় বৈষম্যের সৃষ্টি হয়।

১৯. সঠিক নীতিমালার অভাবঃ কোন পদ্ধতির মাধ্যমে দরিদ্র জনগণ উপকৃত হবে, সঠিকভাবে আয় সবার মাঝে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বন্টিত হবে সেরূপ নীতিমালার অভাব।

২০. পক্ষপাত দুষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রশাসনঃ সরকার রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারিদেরগণ যদি ধনী সম্প্রদায়ের পছন্দের কাজ করতে দিনাতিপাত করেন, তবে দেশে দরিদ্রা জনগণ কোন দিন ও আয় বৈষম্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পারবে না।

উপসংহারঃ উপরিক্ত কারণে বাংলাদেশে মানুষে মানুষে চরম আয় বৈষম্য বিদ্যমান এবং দেশের জাতীয় আয়ের বণ্টনে এরূপ বৈষম্য ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আয়ের ব্যবধান ক্রমাগত বেড়েই চলছে।