বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অর্থনৈতিক বৈষম্যের ভূমিকা আলোচনা কর।

অথবা, তুমি কি মনে কর যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পিছনে ‘অর্থনৈতিক
বৈষম্য’ মূল কারণ ছিল?
অথবা, “পাকিস্তানের বৈষম্য নীতি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে”-আলোচনা কর।
অথবা, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পরে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানে কিরূপ অর্থনৈতিক বৈষম্য গড়ে ওঠে? বর্ণনা দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হলে প্রদেশগুলোকে লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার দাবি করায় বাংলার মুসলমানরা পাকিস্তান সৃষ্টিকে সমর্থন জানায়। কিন্তু ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পাকিস্তান সরকার প্রদেশে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া নিয়ে গড়িমসি শুরু করে এবং কেন্দ্রে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার জন্য সচেষ্ট হয়
এবং পূর্ব পাকিস্তানের সাথে সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতিতেও বৈষম্যমূলক আচরণ করতে থাকে। এসব বৈষম্যের মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ সৃষ্টি করে। ১৯৬০ এর দশকে বৈষম্য চরম আকার ধারণ করলে পূর্ব বাংলার জনগণ প্রথমে প্রতিবাদী আন্দোলন এবং পরবর্তীতে স্বাধিকার আন্দোলন এবং শেষ পর্যায়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন করে। রওনক জাহান যথার্থই বলেছেন যে, “পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালি জাতিই প্রথম সাফল্যজনক মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে
অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদের অবসান ঘটিয়ে নতুন রাষ্ট্র অভ্যুদয় ঘটাতে সক্ষম হয়।”
অর্থনৈতিক বৈষম্য : পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান অসম্মানজনক ও ভয়াবহ অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের ফলে পূর্ব বাংলার অর্থনীতি স্বয়ংসম্পূর্ণতা হারিয়ে ফেলে। মূলত অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চাৎপদ ভূমিতে পরিণত করে। মুদ্রা ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রদেশকে দেওয়া হয়নি। ব্যাংক, বিমা, অফিস, আদালত ইত্যাদি পশ্চিম পাকিস্তানে তৈরি হওয়ায় অবাধে সম্পদ -“পাচার সহজ হয়। পূর্বের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান ও উদ্বৃত্ত আর্থিক সঞ্চয় পশ্চিমের নিয়ন্ত্রণে থাকায় সৃষ্টি হয়
আকাশপাতাল বৈষম্য। নিচে পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বরূপ দেখানো হলো :
১. উন্নয়ন পরিকল্পনায় বৈষম্য : প্রথম পঞ্চবার্ষিকীতে পূর্বের জন্য নির্ধারিত ব্যয় ছিল ৩০০ কোটি ২০ লক্ষ রুপি কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্যয় হয় ১১৩ কোটি ৩ লক্ষ ৮০ হাজার। অপরদিকে, পশ্চিমের জন্য নির্ধারিত ছিল ৫০০ কোটি। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকীতেও পূর্বের ও পশ্চিমের বৈষম্য দেখা যায়। পূর্বের জন্য ৯৫০ কোটি ও পশ্চিমের জন্য ১,৩৫০ কোটি টাকা উন্নয়ন ব্যয়ে নির্ধারিত হয়।
২. আমদানি-রপ্তানি : ১৯৪৭-৭০ সালের মধ্যে পাকিস্তানের মোট রপ্তানি আয়ে পূর্ব বাংলার অবদান ৫৪.৭% কিন্তু আমদানি ক্ষেত্রে তারা ভোগ করে মাত্র ৩১.১%।
৩. মাথাপিছু আয় : ১৯৪৯-৫০ সালে পূর্ব বাংলায় মাথাপিছু আয় ও পশ্চিমের মাথাপিছু আয়ের বৈষম্য ছিল ২১.৯%। ২০ বছর পর ১৯৫৯-৭০ সালে মাথাপিছু আয়ের বৈষম্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬১%।
৪. বৈদেশিক সাহায্য বণ্টনে বৈষম্য : ১৯৪৭-৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান বিদেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ সাহায্য পায়। তার মাত্র ৩০% কাগজেকলমে পূর্ব বাংলাকে দেওয়া হয় কিন্তু বাঙালি অর্থনীতিবিদদের মতে ২১% এর বেশি দেওয়া হয়নি যদিও পূর্ব বাংলার প্রাপ্য কমপক্ষে জনসংখ্যা অনুযায়ী ৫০%।
৫. সম্পদ পাচার : প্রতিবছর লজ্জাজনকভাবে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব বাংলা থেকে প্রায় ৩,০০০ মিলিয়ন রুপির সম্পদ পাচার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যেত। এক হিসাবে দেখা যায় যে ১৯৪৮-৪৯ থেকে ১৯৬৮-৬৯ পর্যন্ত ২০ বছরে সম্পদ পাচার হয় মোট ১১.৮ বিলিয়ন টাকা যা পাকিস্তানের মোট উন্নয়নের প্রায় ১৯%।
অন্যান্য : এছাড়াও রয়েছে অবকাঠামো উন্নয়নে পূর্ব পাকিস্তানকে অবহেলা। সকল কলকারখানা পশ্চিমে তৈরি এবং কাঁচামাল পূর্ব থেকে নেওয়ার ফলে পূর্ব বাংলায় পুঁজি বা মূলধন গড়ে উঠতে না দেওয়া, পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের কলকারখানার কাঁচামালের যোগানদাতা ও উৎপাদিত পণ্যের বাজার হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
এসব অর্থনৈতিক বৈষম্য যখন চরম সীমায় পৌঁছায় তখন আন্দোলন শুরু করে। প্রথমে প্রতিবাদী আন্দোলন, এরপরে স্বাধিকার আন্দোলন এবং সর্বশেষে স্বাধীনতা আন্দোলন।
স্বাধীনতা আন্দোলনে অর্থনৈতিক বৈষম্যের ভূমিকা : পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তান বাংলার মানুষের সাথে সাথে বৈষম্য শুরু করে সর্বপ্রথম ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে বৈষম্য দেখালে মানুষ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে এবং ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন করে। ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে উন্মেষ হয়, তা পরবর্তীতে
অর্থনৈতিক বৈষম্যের জন্য যেসব আন্দোলন হয় তার মাধ্যমে সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছায়। ৫২ এর সময় গুটিকয়েক জনগণকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিল, তাদের মধ্যে ছিল ছাত্র, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীরা কিন্তু গ্রামের কৃষক, শ্রমিক ও সর্বসাধারণরা একত্র হয়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রতি রুখে দাঁড়াতে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার৷ জন্য বিখ্যাত ৬ দফা সম্পর্কে প্রফেসর রওনক জাহান বলেন, “ইতোপূর্বে পরিচালিত আন্দোলনগুলোর ক্ষেত্রে জনসভা ও শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা অনুষ্ঠানের কলাকৌশল গ্রহণ করা হতো, হয়তো পুলিশের সঙ্গে মৃদু সংঘর্ষ হতো। ছয়দফা আন্দোলনের ঘোষণা সরকারি কর্তৃত্বকে সরাসারি চ্যালেঞ্জ করে এবং সংগ্রামী জনতা হরতালের সঙ্গে থানা আক্রমণ, অস্ত্রলুট৷ ও পুলিশের সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।”
অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাংলার প্রতিক্রিয়া : বাংলার মানুষের প্রতি সকল বৈষম্যের দরুন বাংলায় যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তা তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায়ে প্রতিবাদ, দ্বিতীয় পর্যায়ে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার
আন্দোলন, শেষ পর্যায়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ।
প্রথম পর্যায় : বাঙালি অর্থনীতিবিদদের সমালোচনা : পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকার তত্ত্ব দেয় যে, রাষ্ট্রের এক এলাকায় যে খরচ বা বিনিয়োগ হবে তার সুফল দুই এলাকার মানুষই উপভোগ করবে কেননা দুই এলাকার অর্থনীতি বিচ্ছেদ। এ তত্ত্বের প্রতিবাদে ১৯৫৬ সালে বাঙালি অর্থনীতিবিদ ড. মাজাহারুল হক, ড. সাদেক এবং ড. মীর্জা নুরুল হুদার
সামালোচনা করেন এবং এ তত্ত্বের প্রতিবাদে দুটি অর্থনৈতিক তত্ত্ব ঘোষণা করে। ১৯৬২ সালে বাঙালি অর্থনীতিবিদদের চাপে ফাইন্যান্স কমিটি গঠন : ১৯৬২ সাল আইয়ুব খান পূর্ব বাংলা সফরে আসলে এখানে বাঙালি অর্থনীতিবিদদের চাপে পড়ে তিনি দুই অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা স্বীকার করেন এবং এ বৈষম্য দূর করার জন্য ১৯৬২ সালে ফাইন্যান্স কমিশন গঠন করেন। যদিও তা ব্যর্থ হয়।
তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে বিতর্ক : ১৯৬৫ সালের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। অর্থনীতিবিদ প্যানেলের আলোচনায় আঞ্চলিক বৈষম্য, সরকারি খাতে ভূমিকা ও ভূমিসংস্কার বিষয়ে বিতর্ক ক্রমেই তীব্র হয় যে, প্যানেলের চেয়ারম্যান কমিশনের মুখ্য অর্থনীতিবিদ এম এল কোরেশী দুই বা তিন বৈঠকের পরই আলোচনা হঠাৎ বন্ধ
করে দেয়।
দ্বিতীয় পর্যায় : ১৯৬০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে পার্লামেন্টের এমন কোনো অধিবেশই বসেনি যেখানে বৈষম্য আলোচ্য বিষয় ছিল। ১৯৬২ সালে আইয়ুবের সামরিক শাসন প্রত্যাহারের পর মাত্র অর্থনীতিবিদগণ একত্র হয়ে অর্থনৈতিক বৈষম্যকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করে।
ছয়দফা আন্দোলন : ১৯ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের গোলটেবিল আলোচনায় আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি উত্থাপন করে। ঐতিহাসিক ছয়দফা কর্মসূচি মূলত আঞ্চলিক অসমতাকে ভিত্তি করে তৈরি হয়। ছয়দফায় ৩টি দফাই অর্থ রাজস্ব ও বৈদেশিক বাণিজ্য নীতিনির্ধারণের ক্ষমতা অঞ্চলগুলোর হাতে অর্পণের দাবি জানানো হয়। এতে অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্য রোধ ও সম্পদ পাচার রহিত করার লক্ষ্যে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে পৃথক মুদ্রা চালুর প্রস্তাব দেওয়া হয়।
ছয়দফার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করলে পাকিস্তান সরকার একে দমন করার চেষ্টা করে। ফলে জনগণ আরো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
‘৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান : ১৯৬৯ সালে আন্দোলন ছিল ছয়দফার আন্দোলনকারীদের মুক্তি কিন্তু তা পরবর্তীতে গণআন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের রূপ লাভ করে এবং তার সাথে অর্থনীতিসহ সকল বৈষম্যের থেকে মুক্তি
লাভের দাবি জানায়।
‘৭০ এর নির্বাচন : ‘৭০ এর নির্বাচনের মূল ইস্যু ছিল ৬ দফার মাধ্যমে বৈষ্যম্যের অবসান। নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে “সোনার বাংলা শ্মশান কেন” শিরোনামে আওয়ামী লীগের পোস্টারটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। নির্বাচনের প্রচারণার সময় বাঙালি রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে তাদের অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে এবং ১৯৭০ সালে বাংলার মানুষ তাদের অর্থনৈতিক ভাগ্য উন্নয়নের জন্যই আওয়ামী লীগকে ভোটে বিজয়ী ঘোষণা করে এবং এরই সাথে বাংলার মানুষ এও ঘোষণা করে যে বাংলার মানুষ আর বৈষম্যের শিকার হতে চায় না।
শেষ পর্যায় : বাংলার মানুষের শেষ প্রতিক্রিয়া হলো স্বাধীনতা আন্দোলন। ‘৬৬, ‘৬৯, ‘৭০ এর আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলার দাবি ও বৈষম্য দূর না হওয়ার ফলে এবং পাকিস্তানের এ দাবির বিরুদ্ধে দমননীতি প্রয়োগ করার ফলে বাংলার মানুষ তাদের সকল বৈষম্য থেকে মুক্তি লাভ করার জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের মাধ্যমে
তারা তাদের স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তানের সৃষ্টির পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য করা হয় তা পাকিস্তানের শাসকগণ স্বীকার করে। কিন্তু এ বৈষম্য নিরসনে তারা কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি বরং বৈষম্য দূর করার জন্য বাংলার মানুষ যতবার প্রতিবাদ ও আন্দোলন করেছে, তাদের উপর পশ্চিমের অত্যাচার নেমে এসেছে এবং এ বৈষম্য থেকে উত্তরণের জন্য শেষ পর্যন্ত বাঙালিরা স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত হয় এবং নয় মাস যুদ্ধের পর বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলে।