অথবা, বাংলাদেশে চিত্তবিনোদন ব্যবস্থার স্বরূপ বর্ণনা কর। এদেশে চিত্তবিনোদন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের জন্য গৃহীত পদক্ষেপসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে বিনোদন ব্যবস্থাগুলো বর্ণনা কর। এদেশে বিনোদন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
অথবা, বাংলাদেশে চিত্তবিনোদন ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা বর্ণনা কর। এদেশের মানুষের চিত্তবিনোদন ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কী কী কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে বলে তুমি মনে কর।
অথবা, বাংলাদেশে চিত্তবিনোদন ব্যবস্থার পর্যালোচনা কর। এক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য আর কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় বলে তুমি মনে কর?
উত্তর৷ ভূমিকা : মানবজীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি মৌলিক চাহিদা হিসেবে স্বীকৃত হল চিত্তবিনোদন।চিত্তবিনোদন প্রত্যেকটি মানুষের জন্যই কমবেশি প্রয়োজন। যদিও চিত্তবিনোদনের ক্ষেত্রে ব্যক্তির আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার বিষয়টি অনুপস্থিত। তারপরেও চিত্তবিনোদনের মাধ্যমে মানসিক ও শারীরিক কল্যাণ সাধিত হয়। চিত্তবিনোদনের মাধ্যমে মানুষ আনন্দ, সন্তোষজনক ও গঠনমূলক অভিজ্ঞতা লাভ করে। তার মধ্য থেকে অলসতা, অপরাধপ্রবণতা, কুচিন্তা, মানসিক অবসাদগ্রস্ততা, হতাশা ইত্যাদি দূরীভূত হয়। বাংলাদেশে মার্কিন চিত্তবিনোদন ব্যবস্থায় সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এখানে একথা বলার সুযোগ নেই যে, বাংলাদেশের জনগণ চিত্তবিনোদনের জন্য উপযুক্ত বা প্রয়োজনীয় উপকরণ পর্যাপ্ত পরিমাণে পেয়ে আসছে। তারপরও এদেশের মানুষের চিত্তবিনোদনের জন্য সরকারি বেসরকারি ও ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন ধরনের প্রচেষ্টা আমরা লক্ষ্য করে আসছি।
বাংলাদেশের সার্বিক চিত্তবিনোদন ব্যবস্থা : এদেশের সার্বিক চিত্তবিনোদন ব্যবস্থাকে আমরা মোটামুটিভাবে দু’টি দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যক্ষণ করতে পারি। যথা : ১. গ্রামীণ সমাজের চিত্তবিনোদন ব্যবস্থা ও ২. শহুরে সমাজের চিত্তবিনোদন ব্যবস্থা। নিম্নে এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
১. গ্রামীণ সমাজের চিত্তবিনোদন ব্যবস্থা : এদেশে গ্রামীণ সমাজে চিত্তবিনোদনের জন্য আধুনিক সুযোগ সুবিধা ও উপকরণের অপর্যাপ্ততা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আমাদের দেশ গ্রাম প্রধান একটি দেশ। এখানে সুদূর অতীতকাল থেকে চিত্তবিনোদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম আয়োজন করা হতো। এর মধ্যে রয়েছে যাত্রাগান, সারিগান, পুঁথিপাঠের আসর ইত্যাদি। এছাড়া গ্রামীণ পরিবেশের উপযোগী বেশ কিছু খেলাধুলা গ্রামে প্রচলিত ছিল। যেমন- কানামাছি, ডাঙ্গুলি, হা-ডু-ডু, বৌচি, কাবাডি ইত্যাদি। পাশাপাশি ধর্মীয় অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক কিছু চিত্তবিনোদন ব্যবস্থাও ছিল। যেমন-
মুসলমানদের প্রধান দুই ঈদ, ঈদে মিলাদুনবী এবং অন্য ধর্মের দোলযাত্রা, নিউইয়ারস, বর্ষবরণ, মেলা ইত্যাদি। এসব বিভিন্ন কার্যক্রম ও আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এদেশের গ্রামগুলোতে চিত্তবিনোদন কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে এসেছে।
তবে পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় চিত্তবিনোদনের নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এখন গ্রামে রেডিও শোনা, টিভি দেখা চিত্তবিনোদনের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে।
২. শহুরে সমাজের চিত্তবিনোদন ব্যবস্থা : বর্তমান বাংলাদেশে শহরায়ণ প্রক্রিয়া দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশে শহরে দৈনন্দিন চিত্তবিনোদনের সুযোগ গ্রামের তুলনায় বেশি। তবে এসব জায়গায় চিত্তবিনোদনের সুযোগ লাভ করা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যয়বহুল। শহরের চিত্তবিনোদন সুবিধার মধ্যে রয়েছে ময়দান, পার্ক, সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ,
চিড়িয়াখানা, যাদুঘর, বাজার এগুলো প্রধানত Public place হিসেবে সকল জনসাধারণ নির্দিষ্ট ফিস প্রদান সাপেক্ষে উপভোগ করতে পারেন। আবার পারিবারিক পর্যায়ে টেলিভিশন, (সাদা-কাল, রঙিন) ভিসিডি, ভিসিআর, স্যাটেলাইট কানেকশন ইত্যাদি। তাছাড়া এখানে রয়েছে খেলাধুলা করার উপযোগী মনোরম স্টেডিয়াম, খোলা ময়দান, রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, এয়ারপোর্ট এসব জায়গা ভ্রমণ করার মাধ্যমেও চিত্তবিনোদনের সুযোগ লাভ করা যায়।
বাংলাদেশে চিত্তবিনোদন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য করণীয়সমূহ :
১. সচেতনতা সৃষ্টিকরণ : এ দেশে চিত্তবিনোদন এখন পর্যন্ত একটি মৌল মানবাধিকার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে নি। দেশের অধিকাংশ জনগণই জানে না চিত্তবিনোদন তাদের অন্যতম মৌলিক অধিকার এবং চিত্তবিনোদনের
মনোসামাজিক ইতিবাচক প্রভাব সম্পর্কেও আরও অজ্ঞ। সুতরাং এদেশে সার্বিক চিত্তবিনোদন ব্যবস্থায় উন্নয়নের জন্য সর্বপ্রথম জনসাধারণকে চিত্তবিনোদনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালানো যেতে পারে।
২. সরকারি নীতিমালা প্রণয়ন : যে কোন কর্মকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য একটি নীতিমালা অনুসরণ করা দরকার। এতে করে ঐ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও করণীয় দিক সম্পর্কে সহজেই জানা যায়।আমাদের দেশের সঠিক চিত্তবিনোদন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে অবশ্যই একটি সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। যাতে সরকার দেশের জনগণের সার্বিক চিত্তবিনোদন ব্যবস্থার মানোন্নয়নের জন্য কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার সে সম্পর্কে উপযুক্ত নির্দেশনা লাভে সক্ষম হয়।
৩. বেসরকারি সংস্থাকে উৎসাহিত করা : দেশের সার্বিক চিত্তবিনোদন ব্যবস্থার মান উন্নয়ন করার কাজটি সরকারের একার পক্ষে নিশ্চিত করা তুলনামূলক একটি জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি কাজ। এক্ষেত্রে সরকার বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করার জন্য
উৎসাহিত করতে পারে। যারা দেশের বিভিন্ন ধরনের পার্ক-থিয়েটার স্থাপন, টিভি চ্যানেল স্থাপনসহ বিভিন্ন ধরনের চিত্তবিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড সৃষ্টি ও পরিচালনা করবে।
৪. সরকারি সম্পদের সদ্ব্যবহার বা চিত্তবিনোদনে ব্যবহার : আমাদের দেশের চিত্তবিনোদন ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য সরকারি সম্পদ ও সম্পত্তির সদ্ব্যবহার নিশ্চত করা যেতে পারে। অর্থাৎ দেশে যেসব খাস জমি আছে এসব খাস জমিতে কিছু কিছু খেলার মাঠ, পার্ক স্থাপনের মাধ্যমে সরকার চিত্তবিনোদন সুবিধা সম্প্রসারণে কাজ করতে পারেন।
৫. চিত্তবিনোদন সামগ্রি বা উপকরণের সহজলভ্যতা : এদেশে চিত্তবিনোদন ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত অসুবিধার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় উপকরণেরও অপর্যাপ্ততা লক্ষণীয়। আবার দেশে যেসব উপকরণ পাওয়া যায় তার দাম সাধারণ
জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। ফলে দেখা যায় এত দাম দিয়ে জনগণ চিত্তবিনোদন সামগ্রী ক্রয় করতে সক্ষম হয় না। এক্ষেত্রে সরকার বিনোদন সামগ্রী আমদানির উপর ট্যাক্স কমানো, প্রয়োজনে বাজার মনিটরিং, দাম নির্ধারণসহ বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।
৬. গ্রামভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ : আমাদের দেশ গ্রাম প্রধান দেশ। তাই এদেশের গ্রামের মানুষের চিত্তবিনোদন ব্যবস্থার মান উন্নয়ন না করে দেশের সঠিক চিত্তবিনোদন ব্যবস্থার মান উন্নয়ন করা সম্ভব নয়।তাই গ্রাম কেন্দ্রীভূত চিত্তবিনোদন সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য গ্রামে নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের নাচ, গান, খেলাধুলা, নাটক, যাত্রা ইত্যাদি আয়োজন করতে হবে।
৭. সমন্বয় সাধন : সমন্বয় সাধনের মূল কথা হল এ কার্যক্রমের পুনরাবৃত্তি রোধসহ নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা। দেশে জাতীয় ও স্থানীয় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পরিচালিত সকল চিত্তবিনোদন কার্যক্রম ও ব্যবহারের সাথে একটি সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করতে হবে। যাকে এক্ষেত্রে একটি সুষ্ঠু অবস্থা সৃষ্টি এবং তা Continue করানো সম্ভব হবে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, আমাদের দেশে বিদ্যমান চিত্তবিনোদন ব্যবস্থা দেশের মোট জনসাধারণের চাহিদা ও প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। দারিদ্র্য পীড়িত এ দেশটিতে ক্ষুধা নিবৃত্তি করাই যেখানে মূল লক্ষ্য সেখানে চিত্তবিনোদনের গুরুত্ব যতই থাক না কেন সেদিকে তাকানোর সময় খুবই কম। তারপরেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এ যুগে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি অন্যতম মৌল মানবিক চাহিদা হিসেবে চিত্তবিনোদনের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তাই দেশের জনসাধারণের মোটামুটিভাবে চিত্তবিনোদনজনিত চাহিদা পূরণ বা নিশ্চিতকরণের জন্য উপযোগী পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে।