বাংলাদেশের সমাজজীবনে ভিক্ষাবৃত্তির প্রভাব আলোচনা কর ।

অথবা, বাংলাদেশের সমাজজীবনে ভিক্ষাবৃত্তির ফলাফল বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের সমাজজীবনে ভিক্ষাবৃত্তির প্রতিক্রিয়া আলোচনা কর।
উত্তর ভূমিকা :
বাংলাদেশ একটি দরিদ্র ও জনবহুল দেশ। এদেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব হচ্ছে ৯৭৭ জন। এদেশে জনসংখ্যার ঘনত্বের ন্যায় অনেক সমস্যা রয়েছে, যা এদেশকে সমস্যাবহুল করে তুলেছে। এদেশের অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে অন্যতম একটি সমস্যা হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি। এসব সমস্যা বর্তমানে সামাজিক সমস্যায় রূপান্তরিত হয়েছে, যা সমাজের জন্য হয়ে উঠেছে মহাঘাতক ব্যাধির ন্যায় মারাত্মক। দেশের বিপুল পরিমাণ ভিক্ষুক রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য বোঝা, অনুৎপাদনশীল জনগোষ্ঠী এবং জাতীয় আয়ের এক বিরাট অংশ অন্ন ধ্বংসকারী। তদানীন্তন পাকিস্তানের সামাজিক অনাচার বিলোপ কমিশনের প্রতিবেদনে ভিক্ষাবৃত্তিকে মারাত্মক সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে এটাকে সবচেয়ে বেশি স্থায়ী ও সংকটময় অবস্থা বলে বর্ণনা করা হয়েছে এবং A symptom of social disorganization হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সমাজজীবনে ভিক্ষাবৃত্তির প্রভাব : কোন সামাজিক অবস্থা বা প্রথা যদি সমাজের জন্য ক্ষতিকর ও সমাজের প্রগতির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, তবে তাকে সামাজিক সমস্যা বলে গণ্য করা হয়। সামাজিক সমস্যার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের আলোকে ভিক্ষাবৃত্তিকে বাংলাদেশের অন্যতম সামাজিক সমস্যা হিসেবে নিঃসন্দেহে গণ্য করা যায়। বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরাঞ্চলে যে হারে পেশাদার ভিক্ষুকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ভিক্ষাবৃত্তি দূরীকরণে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যৌথ কার্যক্রম গৃহীত হচ্ছে। এককথায় সামাজিক সমস্যার সবগুলো বৈশিষ্ট্যই ভিক্ষাবৃত্তির ক্ষেত্রে বিদ্যমান। বাংলাদেশের সমাজজীবনে ভিক্ষাবৃত্তির প্রভাবকে নিম্নোক্ত দৃষ্টিকোণ থেকে
আলোচনা করা যেতে পারে : ক. অর্থনৈতিক প্রভাব, খ. সামাজিক প্রভাব, গ. নৈতিক প্রভাব ও ঘ. স্বাস্থ্যগত প্রভাব।
ক. অর্থনৈতিক প্রভাব : নিম্নে ভিক্ষাবৃত্তির অর্থনৈতিক প্রভাবগুলো আলোচনা করা হলো :
১. নির্ভরশীলতা : ভিক্ষুকরা সম্পূর্ণভাবে অপরের উপর নির্ভরশীল। অপরের অর্জিত আয়ের একটা অংশ তারা ভোগ করে। এভাবে পরনির্ভরতা একই সাথে নিজের এবং অপরের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে। ভিক্ষুকরা নিজেরা কোন আয় করে না, ফলে সমাজের অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যাহত হয়। তাদের শ্রম কোন কল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার করা যায় না।
২. অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা: ভিক্ষুকরা কোন উন্নয়নমূলক কাজে তাদের মেধা ও শ্রম ব্যয় করে না। তারা সম্পূর্ণভাবে অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এভাবে তারা অপরের অর্জিত আয়ের একটা অংশ ভোগ করতে প্রবৃত্ত হয়, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বড় ধরনের বাধা হিসেবে কাজ করে।
৩. শ্রমের অপচয় : ভিক্ষুকরা যে সময় ব্যয় করে অপরের অর্থের ভাগীদার হয়, সে সময় উন্নয়নমূলক বা উৎপাদনমূলক কাজে ব্যবহার করে অধিক অর্থ উপার্জন করা যায়। কিন্তু ভিক্ষুকরা তাদের শ্রমের অপচয় ঘটিয়ে অপরের করুণার পাত্রে পরিণত হয়। ভিক্ষুকরা যে সময় ব্যয় করে অপরের করুণা প্রার্থনা করে, সে সময় তারা উৎপাদনমূলক কাজে ব্যয় করলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতে পারে।
৪. ভোগবৃত্তি : ভিক্ষুকরা শুধু ভোগ করতে জানে, তারা কোন প্রকার কাজে অংশগ্রহণ করে না। এভাবে সমাজের একটা অংশ শুধু ভোগ করতে থাকলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে পড়ে।
৫. বৈষম্য সৃষ্টি : বাংলাদেশে ভিক্ষাবৃত্তি অর্থনৈতিক বৈষম্যেরই পরিচায়ক। বস্তুত যারা ভিক্ষা করে তারা অর্থনৈতিকভাবে একেবারেই পঙ্গু। সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্যকে ভিক্ষুকরা সমাজের নিকট নগ্নভাবে উপস্থাপন করে।
খ. সামাজিক প্রভাব : নিম্নে ভিক্ষাবৃত্তির সামাজিক প্রভাবগুলো আলোচনা করা হলো :
১. কর্মসংস্থান হ্রান্স : ভিক্ষুকরা ভোগবৃত্তির মাধ্যমে জীবিকানির্বাহ করে। কোন কোন ভিক্ষুককে অলস মাংসপিণ্ড ছাড়া অন্যকিছুই ভাবা যায় না। তারা রাস্তার ধারে, ফুটপাতে ও ওভার ব্রিজে বিভিন্ন জায়গায় বসে ভিক্ষা করে। তাদের দ্বারা সমাজের কোন উন্নয়নমূলক কাজ সম্পাদন একেবারেই অসম্ভব। তারা অলস হতে শেখে। ভিক্ষুকদের নিশ্চিত আয় তাদেরকে শ্রমবিমুখ হতে উৎসাহিত করে। তাদের কর্মস্পৃহা ক্রমশ হ্রাস পায়। সামাজিক জীবনে কর্মস্পৃহা হ্রাস পেলে সামাজিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
২. জীবনযাত্রা ব্যাহত করা : বাংলাদেশে রাস্তাঘাট, মসজিদ, বাজার, ফেরি, লঞ্চঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত, ট্রেন, বিনোদনের স্থান, পার্ক, বাসাবাড়ি, হাসপাতালসহ সমাজের প্রায় সর্বত্র ভিক্ষুকদের দেখা যায়। তারা মানুষের স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতি ব্যাহত করে। কখনও কখনও তারা নাছোড়বান্দার ন্যায় আচরণ করে, যা জনমনে দারুণভাবে বিরক্তির উদ্রেক করে। ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ রজনীতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভিক্ষুকদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পায়।
৩. অসামাজিক কার্যকলাপ : ভিক্ষুকরা বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয় এবং অসামাজিক কার্যকলাপে সাহায্য করে। যৌনাচার, গাঁজার আসর, হিরোইন সেবন প্রভৃতি কাজে ভিক্ষুকদের অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় ।
৪. অপরাধ প্রবণতা : ভিক্ষুকরা সমাজে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীরা ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে অপহরণ, চুরি, ডাকাতি, যৌনাচার প্রভৃতি কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
৫. আইনশৃঙ্খলার অবনতি : সমাজে অপরাধীরা আইনের হাত থেকে বাঁচার জন্য ভিক্ষুকদের ছদ্মবেশ গ্রহণ করে। এভাবেই তারা অপরাধ কর্ম চালাতে থাকে। ফলে সমাজে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে।
গ. নৈতিক প্রভাব : নিম্নে ভিক্ষাবৃত্তির নৈতিক প্রভাবগুলো আলোচনা করা হলো :
১. আত্মমর্যাদা হ্রাস : ভিক্ষুকরা সবার করুণার পাত্র। সমাজ সর্বদা ভিক্ষুকদের হেয় প্রতিপন্ন করে। ভিক্ষুকদের মর্যাদাবোধ বলতে কিছুই থাকে না। সমাজে তাদের অবস্থান সর্বনিম্নে।
২. চরিত্র কলুষিত করা : ভিক্ষুকরা নিজেরা কোন আত্মমর্যাদায় আসীন হয় না। অপরের আত্মমর্যাদা তথা চরিত্র কলুষিত করতে তারা সহায়তা করে। কোন কোন মহিলা ভিক্ষুক পতিতাবৃত্তির সাথে জড়িত। আবার মহিলা ভিক্ষুক সমাজের যুবতীদের পতিতাবৃত্তি, মাদক ব্যবসায় প্রভৃতি অপরাধমূলক কর্মে উৎসাহিত করে।
৩. ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত : ভিক্ষুরা ধর্মবাণী শুনিয়ে অপরের নিকট ভিক্ষা প্রার্থনা করে। কিন্তু স্বয়ং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) ভিক্ষাবৃত্তিকে সমর্থন করতে পারেন নি। এভাবে ভিক্ষুকরা ধর্মপ্রাণ মানুষের অনুভূতিতে আঘাত হানে।
ঘ. স্বাস্থ্যগত প্রভাব : নিম্নে ভিক্ষাবৃত্তির স্বাস্থ্যগত প্রভাবগুলো আলোচনা করা হলো :
১. রোগ বিস্তার : ভিক্ষুকরা স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করতে পারে না। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করার ফলে বিভিন্ন রোগব্যাধিতে তারা আক্রান্ত হয়ে পড়ে। মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে তারা রোগের সংক্রমণ ঘটায়।
২. পরিবেশ বিনষ্ট করা : ভিক্ষুকদের পোশাক পরিচ্ছদ এবং আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি নোংরা থাকে। তারা যেখানে অবস্থান করে দুর্গন্ধে তাদের আশপাশেই যাওয়া যায় না। এভাবে স্বাভাবিক স্বাস্থ্যকর পরিবেশকে তারা বিনষ্ট করে।
৩. বিকলাঙ্গতা : অনেক ভিক্ষুক তাদের বিকলাঙ্গ প্রদর্শন করে ভিক্ষা করে। ভিক্ষুকদের বিকলাঙ্গতা শিশুদের মানসিকতাকে বিপর্যস্ত করে তুলে।
৪. জনস্বাস্থ্যের নগ্নচিত্র প্রদর্শন : ভিক্ষুকরা দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী, বিকলাঙ্গ বা রোগপীড়িত। জনসম্মুখে ভিক্ষুকের বিচরণ জ াতীয় স্বাস্থ্যকে নগ্নভাবে উপস্থাপন করে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশে ভিক্ষাবৃত্তি একটি মারাত্মক সামাজিক সমস্যা। এটি এমন এক সমস্যা, যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে অধিকাংশ লোকের উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করছে এবং সমাজ উন্নয়নের প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। এজন্য সমাজবাসী এর প্রতিকার কামনা করে। এর প্রতিকার, প্রতিরোধ ও উন্নয়নে সমাজবাসী সচেতন এবং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন ।