অথবা, বাংলাদেশের শিশুরা কী কী সমস্যার সম্মুখীন হয়?
অথবা, আমাদের দেশের শিশুদের প্রধান প্রধান সমস্যাগুলো কী কী?
অথবা, আমাদের দেশে শিশুদের সমস্যাবলি সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
অথবা, আমাদের দেশে শিশুদের সমস্যাবলি তোমার নিজের ভাষায় লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : একটি দেশ তথা জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার হল শিশু। কারণ আজকের শিশুই আগামীদিনের দেশ ও জাতির পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করবে। তাই বর্তমান বিশ্বে শিশুর চাহিদা ও প্রয়োজনের মধ্য দিয়ে তাদের সমস্যা মোকাবিলার প্রচেষ্টা চালানো হয়। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে এ প্রচেষ্টা বেশি মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়, তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোও এ ব্যাপারে আস্তে আস্তে সচেতন হচ্ছে। পেশাদার সমাজকর্মেও শিশু এবং শিশুকল্যাণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে বিবেচিত। তাই সমাজকর্মের ছাত্র হিসেবে আমাদের শিশু, শিশুর সমস্যা, সমস্যা সমাধান কৌশল ইত্যাদি সম্পর্কে বিশেষভাবে জানা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের শিশুদের সমস্যাসমূহ : আমাদের দেশে শিশুদের মাঝে তাঁদের সার্বিক চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণ না হওয়ার ফলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। সেগুলো নিম্নরূপ :
১. প্রতিবন্ধী শিশু : যেহেতু শিশুর চাহিদা তার মাতৃগর্ভ থেকে শুরু হয় তাই মায়ের পেটে থাকাকালীন মা যদি যথাযথ পরিচর্যা না পায় তবে তা শিশুকে প্রভাবিত করে। মা যদি কোন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন, নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করেন, অতিরিক্ত ঔষধ গ্রহণ করেন তবে ঐ মা অনেক সময়ই প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম দিয়ে থাকেন।
২. পুষ্টিহীনতা : মানুষের দেহে ছয়টি খাদ্য উপাদান যখন সঠিক মাত্রায় না থাকে অর্থাৎ কোন কোন উপাদানের ঘাটতি থাকে তখন সে অবস্থাকে পুষ্টিহীনতা বলে। আমাদের দেশে প্রায় ৭০% শিশু পুষ্টিহীনতার শিকার। কারণ দেখা যায়, আমাদের অধিকাংশ জনসাধারণই দরিদ্র। ফলে তাদের পক্ষে তাদের শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবার প্রদান করা সম্ভব হয় না। ফলে এসব শিশুরা ব্যাপকহারে পুষ্টিহীনতার শিকার হয়।
৩. নিরাপত্তাহীনতা : শিশুরা হল সমাজের সবচেয়ে অক্ষম ও অসহায় শ্রেণী। তাদের চাহিদা তাদের নিজেদের দ্বারা পূরণ করা আদৌ সম্ভব নয়। এজন্য তাদেরকে তাদের মা-বাবা, পরিবার তথা সমাজের উপর নির্ভর করতে হয়। শিশুদের চাহিদা যদি যথাযথভাবে পূরণ না হয় তবে তাদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠা এমনকি বেঁচে থাকার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।
৪. শিশু নির্যাতন : নির্যাতন হল একধরনের আঘাত বা ক্ষতি। শিশুরা অনেক সময় দেখা যায় নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। তাদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত করা হয়। এসব ক্ষেত্রে তাদের পারিশ্রমিক তো দেওয়া হয়ই না, তার উপরে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। অকথ্য ভাষায় তাদের গালিগালাজ করা হয়।
৫. শিশু অপরাধ : সমাজকর্তৃক অসমর্থিত অথচ শিশু বয়সীদের দ্বারা সংঘটিত কর্মকাণ্ডই সমাজে শিশু অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। শিশুদের চাহিদা পূরণ না হওয়ার ফলে তারা অপরাধমূলক কাজে প্রবৃত্ত হয়। যেমন- কোন শিশু যদি নিয়মিত খাবার না তবে সে ক্ষুধার তাড়নায় খাবার চুরি করতে বাধ্য হয়। আস্তে আস্তে চুরি বিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করে।
৬. নৈতিকতার অবক্ষয় : ভালোমন্দ, সঠিক বেঠিক ইত্যাদি উপলব্ধি করা এবং ইতিবাচক বিষয়টি গ্রহণ করার মধ্য দিয়েই নৈতিকতার প্রকাশ পায়। যে শিশু সত্য মিথ্যা, ভালোমন্দ সম্পর্কে শিক্ষা পায় না, যে আদর, স্নেহ, মমতা বঞ্চিত পরিবেশে বেড়ে উঠে তার মধ্যে নৈতিকতার অবক্ষয় দেখা দেয় । সত্য মিথ্যা, ভালোমন্দ এসবের কোন অনুভূতি তার মধ্যে দেখা যায় না।
৭. সামাজিকীকরণের অভাব : সামাজিকীকরণ একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। পরিবার থেকে শিশুর এ সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু যে পরিবারে শিশুর চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ হয় না সে পরিবারের শিশুর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় মারাত্মকভাবে। ফলে শিশু সমাজের উপযোগী আচরণ প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়। সামাজিকভাবে নিজেকে খাপখাওয়াতে ব্যর্থ হয়।
৮. শিশু পাচার বৃদ্ধি : চাহিদা অপূরণজনিত সমস্যার কারণে শিশুরা শিশু পাচারজনিত সমস্যায় পতিত হয়। দরিদ্র পরিবারের শিশুদের কাজের আশায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রদান করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক শিশু পাচার হয়ে যায়।তাই শিশু পাচারজনিত সমস্যা বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যায় উপনীত হয়েছে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আমাদের দেশের মত একটি উন্নয়নশীল দেশে শিশুদের বহুমুখী সমস্যা বিদ্যমান, যার জন্য তারা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় শারীরিক ও মানসিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে। তাই বলা যায়, এ দেশের শিশুদের সমস্যা সমাধানের জন্য আলোচ্য সুপারিশগুলো গ্রহণ সাপেক্ষে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।