বাংলাদেশের রেমিট্যান্স খাত

যে কোনো দেশের অর্থনীতিকে উচ্চ লেভেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য রেমিটেন্স খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিটেন্সের প্রভাব রয়েছে। আপনি হয়ত ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের রেমিটেন্স খাতের কথা শুনেছেন। তবে বুঝতে পারছেন না যে, রেমিটেন্স কি বা রেমিট্যান্স কাকে বলে।

আজ আমি আপনাকে রেমিটেন্স (Remittances) এর পুরো বিষয়বস্তু সহজ ভাবে বুঝিয়ে দেবো। সেই সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিটেন্সের গুরুত্ব ও রেমিটেন্স যোদ্ধাদের অবদানের কথাও তুলে ধরবো।

বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ভাবে সচল রাখলে লক্ষ লক্ষ রেমিটেন্স যোদ্ধা বছরের পর বছর সময় ধরে নির্দ্বীধায় কাজ করে যাচ্ছে। তাদের কষ্ট ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে এদেশের অর্থনীতিতে প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে।

বাংলাদেশ একটি মধ্যবিত্ত আয়ের দেশ। তাই এদেশের অর্থনীতিতে রেমিটেন্স এর গুরুত্ব অপরসীম। রেমিটেন্স যোদ্ধাদের উৎসাহ প্রদানে বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই রেমিট্যান্স প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছে।

রেমিটেন্স (Remittances) একটি ইংরেজি শব্দ। যার অর্থ হলো প্রেরণ করা।

অর্থাৎ, বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে দেশে পাঠানো। সহজ ভাবে বলতে গেলে বিদেশে যারা কাজ করে নিজের দেশে অর্থ পাঠায় তাদের জন্য এটাই রেমিটেন্স (Remittances)।

রেমিটেন্স একটি দেশের জিডিপি (Gross domestic product) বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের নাগরিকদের মাথাপিচু আয় উন্নতি করে। যেটা বিশ্ব অর্থনীতিতে দেশকে এগিয়ে রাখে এবং দেশের বিনিয়োগ ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

বিদেশে কর্মরত অভিবাসী কর্মীরা নিজদেশে পরিবার বা আত্মীয় স্বজনের কাছে যে উপার্জিত অর্থ প্রেরণ করে তাকে রেমিটেন্স বলে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স। রেমিট্যান্স বলতে বোঝায় বিদেশে কর্মরত কোনো নাগরিক যখন দেশে অর্থ পাঠায়। অধিক বেতন, উন্নত কর্মপরিবেশ ও উন্নত জীবনযাপনের আশায় মানুষ নিজ দেশ ছেড়ে অন্যান্য দেশে পাড়ি জমায়। এসব প্রবাসীর পাঠানো রেমিট্যান্স একটা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে। রেমিট্যান্স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের মাথাপিছু আয় এবং মোট জিডিপিও বৃদ্ধি পায়। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রবাসী আয়ের অর্থ দেশের দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা, শিশুর পুষ্টি ও শিক্ষার ক্ষেত্রেও অবদান রাখছে।

প্রবাসীরা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এক হাজার ৬৪২ কোটি ডলার এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক হাজার ৮২০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন, যা বিগত বছরগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। করোনা মহামারির কারণে রেমিট্যান্স কমে যাবে বলে ধারণা করা হলেও তা হয়নি। এর কারণ হলো অতিমারির ফলে অবৈধ পথে অর্থ প্রেরণ বাধাগ্রস্ত হয়, যার  ফলে প্রবাসীদের ব্যাংক মাধ্যমে টাকা পাঠাতে হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে সব মিলিয়ে প্রবাসী আয় এসেছিল প্রায় দুই হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি।

মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ প্রবাসী কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি রয়েছে সৌদি আরবে। সেখানে তাদের সংখ্যা প্রায় ১ দশমিক ২ মিলিয়ন। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওমান, জর্ডান, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে প্রবাসীরা কাজ করছেন। তবে মানতেই হয়, তাদের মধ্যে দক্ষ শ্রমিক থেকে অদক্ষ ও স্বল্পশিক্ষিত শ্রমিকের সংখ্যাই অনেক বেশি।

গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল দুই কোটি ৩৭ লাখ ডলার, যা ২০০০ সালে বেড়ে পৌঁছে ১৯৫ কোটি ডলারে। বর্তমানে তা দুই হাজার ৪৭৮ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। জিডিপি’তে রেমিট্যান্সের অবদান ছয় শতাংশেরও বেশি। ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে সংকটমুক্ত করতে ভূমিকা রেখেছিল রেমিট্যান্স। রেমিট্যান্সের কারণে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও অনেক বেড়েছে।

প্রবাসীরা বাংলাদেশে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হুন্ডিকে প্রাধান্য দেয়। হুন্ডি হলো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ব্যক্তিগত পর্যায়ের অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থ পাঠানোর মাধ্যম। ২০০৬ সালে গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টের (জিইপি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে পাঠানো প্রবাসী অর্থের ৫৬ ভাগই আসে হুন্ডির মাধ্যমে। তাই আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের ব্যবহারের জন্য সরকার এখন ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছে। এছাড়া অর্থ পাঠানোর প্রক্রিয়া অতীতের তুলনায় সহজ করার ফলে প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।

চার বছর ধরেই দেশে বাড়ছিল রেমিট্যান্সের পরিমাণ। এমনকি রেকর্ডসংখ্যক কর্মীও প্রবাসে গিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে প্রবাসী আয় না বেড়ে বরঞ্চ আগের তুলনায় কমেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এর একটি বড় কারণ হলো, বৈধ পথে আয় পাঠাতে খরচ বেশি হয়। আর অনানুষ্ঠানিকভাবে (হুন্ডি) আয় পাঠালে প্রতি ডলারে পাঁচ-ছয় টাকা বেশি দেয়া লাগে, যার কারণে অনেকে টাকা পাঠানোর মাধ্যম হিসেবে হুন্ডি বেছে নিয়েছেন। এছাড়া ব্যবসায়ীরা ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার জন্য ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিং করেন।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে রেমিট্যান্সের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্ববাজারে শ্রমিকের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রবাসী আয় আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব। সরকার প্রবাসী আয়ে প্রণোদনার পরিমাণ আরও বাড়াতে পারে। এটি অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে অর্থ পাঠানো কমাতে সাহায্য করবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশীয় শ্রমিকের বড় একটি অংশ যেহেতু অদক্ষ, তাদের দক্ষ করে তুলতে হবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। তাহলে দেশের অভিবাসী শ্রমিকদের শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন সম্ভব হবে। রেমিট্যান্স বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। সরকার রেমিট্যান্স খাতে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ খাতকে আরও প্রসারিত করতে পারবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাসীদের পাঠানো এ অর্থ দেশের আর্থসামাজিক বিকাশে অন্যতম অনুঘটক হিসেবে বিবেচিত। গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে রেমিট্যান্সের ভূমিকা নিয়ে আলোচনাটা তাই অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। যদিও দেশীয় শ্রমবাজারে শ্রমশক্তির চাহিদা ও জোগানের সমন্বয়হীনতার কারণে প্রবাসের শ্রমবাজার আমাদের শ্রমশক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রস্থল হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে একদিকে যেমন প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্স সামষ্টিক অর্থনীতির ভিতকে শক্তিশালী করছে, তাদের পাঠানো অর্থ দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা, শিশুর পুষ্টি ও শিক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। চলমান মহামারী পরিস্থিতি আমাদের অর্থনীতিকে যে ঝুঁকির সম্মুখীন করেছে, তা মোকাবেলার ক্ষেত্রেও রেমিট্যান্সের অবদান রয়েছে।

একটি বিস্তৃত কাঠামোতে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমশক্তির অভিবাসনের বিভিন্ন দিককে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। তবে সময়ের পালাবদলের হাত ধরে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসনের একটি গঠনমূলক পরিবর্তন ঘটেছে বলে মনে হয়। বর্তমানে আমাদের মোট অভিবাসনের একটি বড় অংশজুড়ে আছে শ্রমিকদের অস্থায়ী দেশান্তর। তবে বাংলাদেশের উন্নয়নে রেমিট্যান্সের প্রভাব নিয়ে আলোচনার আগে, ১৯৭৭ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী দশকজুড়ে মোট অভিবাসন ও প্রবাসী আয়ের ওপর আলোকপাত করাটাও গুরুত্বপূর্ণ, যা আলোচনাকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে বলেই আমি মনে করি। আমরা যদি ১৯৭৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অভিবাসন ও রেমিট্যান্সের তথ্য বিশ্লেষণ করি, তাহলে অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের গুরুত্ব বুঝতে পারব। ১৯৬৭-৭৭ সালে অভিবাসীদের সংখ্যাটা যেখানে ছিল মাত্র ১৪ হাজার, সেখানে ২০০৭-০৮ সালে তা পৌঁছে রেকর্ডসংখ্যক ৯ লাখ ৮১ হাজারে। তবে ২০০৮ সালের আর্থিক সংকট স্বাভাবিকভাবেই বিদেশের শ্রমবাজারকে প্রভাবিত করেছিল। যার সাময়িক প্রভাব আমরা দেখতে পাই ২০১১-১২ থেকে শুরু করে ২০১৪-১৫ সাল পর্যন্ত অভিবাসীদের সংখ্যা হ্রাসের মধ্য দিয়ে। তবে পরবর্তী বছরগুলোতে অর্থাৎ ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের দিকে খানিকটা উন্নতি হতে শুরু করে। সুতরাং ১৯৭৭ থেকে ২০১৬ সালের সময়কালজুড়ে অভিবাসন বৃদ্ধির বিষয়টি আমরা যদি বিশ্লেষণ করি, তবে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ভাগে ভাগ করতে পারি। এক. ১৯৭৬ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তুলনামূলক কম প্রবৃদ্ধি। দুই. ১৯৯১-৯২ সালের তুলনায় ২০০৫-০৬ সাল নাগাদ অভিবাসনের পরিমাণের দ্বিগুণ বৃদ্ধি। তিন. ২০০৭-০৮ সালে রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধির পর তা ওঠানামা করা।

২০১৮ সালে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের অভিবাসী ও শ্রমিকদের গন্তব্যের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বব্যাংক যে তথ্য প্রকাশ করে, সেখানে আমরা দেখতে পাই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বিশেষ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, কাতার ও আফ্রিকার লিবিয়া বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকদের প্রধান গন্তব্যস্থল। তবে মোট অভিবাসীদের মধ্যে ৪৫ শতাংশেরই সৌদি আরবে যেতে ইচ্ছুক। আর বাকি ৭০ শতাংশের গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের বাকি দেশগুলোতে। এছাড়া, বাংলাদেশী অভিবাসীদের তৃতীয় অভিবাসন গন্তব্য মালয়েশিয়া। মোট অভিবাসীদের মধ্যে এ দেশে যেতে ইচ্ছুক প্রায় ১০ শতাংশ। এছাড়া সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর কানাডাও বাংলাদেশের অভিবাসীদের কাছে অন্যতম গন্তব্য হিসেবে উঠে আসে। বাংলাদেশের সরকারের তালিকা থেকে ভারত বাদ পড়লেও বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের তথ্যানুসারে প্রায় ৩ দশমিক ১ শতাংশ বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকের গন্তব্য এ দেশটি।

রেমিট্যান্স নিয়ে কাজ করার সময়, আমরা দেখতে পাই স্থায়ী অভিবাসী এবং বিদেশে অস্থায়ী কর্মীদের ক্ষেত্রে পৃথকের কোনো পৃথক রেকর্ড সরকারের কাছে নেই। পৃথক পরিসংখ্যান স্থায়ী অভিবাসী ও বিদেশে কর্মরত অস্থায়ী অভিবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্সের আরো ভালো চিত্র তুলে ধরতে পারত। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত তথ্যানুসারে, ১৯৭৬-৭৭ সালে মাত্র ৪৯ মিলিয়ন ডলার দিয়ে শুরু হলেও ২০০৮-০৯ সালে রেমিট্যান্স আসে ৯ হাজার ৬৪৯ মিলিয়ন ডলার। ১৯৭৬ সালের উপার্জিত রেমিট্যান্সের তুলনায় যা প্রায় ১৯৮ গুণ বেশি। তবে ২০০৮-০৯ সালের আর্থিক সংকটের তাপ স্বাভাবিকভাবেই বৈদেশিক শ্রমবাজারকে প্রভাবিত করে। ফলে ২০০৯ সালে হঠাৎ করেই বিদেশে শ্রমিক প্রেরণ বা অভিবাসনের পরিমাণ কমে আসে। তবে রেমিট্যান্স প্রবাহে খুব একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না। বরং বলা যায় প্রবৃদ্ধি হয়।

এখানে লক্ষণীয়, বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশের মতো একই বৈশ্বিক প্যাটার্ন অনুসরণ করেছে। তাছাড়া উন্নয়শীল দেশগুলোতে সম্পদ হস্তান্তরের বা উপার্জিত আয় দেশে প্রেরণের বিশেষ সুবিধা বিদ্যমান। উন্নত দেশগুলোতে যা সীমিত। ১৯৮০-৮১ থেকে ২০১৫-১৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহের সরকারি তথ্যানুসারে আমরা দেখতে পাই, এ সময়কালে শুধু সৌদি আরব থেকেই ৩৩ শতাংশ রেমিট্যান্স এসেছে। বাংলাদেশের প্রবাসী আয় প্রবাহের ক্ষেত্রে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর তুলনায় সৌদি আরবের গুরুত্ব বোঝা যায়। মালয়েশিয়াতে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী কর্মী থাকলেও সেখান থেকে রেমিট্যান্স আসে মাত্র ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। এর নেপথ্যে সম্ভাব্য তিনটি কারণ থাকতে পারে। এক. বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়াতে অভিবাসন প্রক্রিয়া দেরিতে শুরু হয়েছে। দুই. বাংলাদেশী শ্রমিকরা এখানে কম দক্ষতাপূর্ণ কাজ করে, স্বাভাবিকভাবেই এতে তাদের আয় কম হয়। তিন. দেশে অর্থ প্রেরণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অবৈধ চ্যানেল ব্যবহার।

তবে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণেরও বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। যেমন, মালয়েশিয়াতে অবস্থানরত বাংলাদেশী বেশির ভাগ শ্রমিকই অবৈধ এবং স্বল্পশিক্ষিত হওয়াতে তারা বিভিন্ন সুবিধাবঞ্চিত। তাই দেশে অর্থ প্রেরণের ক্ষেত্রে তারা অবৈধ চ্যানেলকেই সুবিধাজনক মনে করে।

এ প্রসঙ্গে যে সম্পূরক প্রশ্নটি উত্থাপিত হয় তা হলো, প্রবাসী শ্রমিকরা দেশে কেন রেমিট্যান্স পাঠায়? উত্তরটি জানা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রেমিট্যান্স পাঠানোর অন্তনির্হিত উদ্দেশ্য নিহিত এখানে। কিংবা তাদের প্রেরিত রেমিট্যান্স কী কাজে ব্যবহারিত হয়? এ প্রশ্নের উত্তরগুলো মূলত সামস্টিকভাবে আর্থসামাজিক উন্নয়নকে প্রভাবিত করে। এ যোগসূত্রকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা দেখতে পাই যে অভিবাসীদের রেমিট্যান্স প্রেরণের ক্ষেত্রে মূলত চারটি উদ্দেশ্য রয়েছে। এগুলো হচ্ছে, নিঃস্বার্থপরতা বা পরিবারের সদস্যদের ভরণ-পোষণ, বিনিয়োগ করা, দেনা পরিশোধ এবং যৌথ-বীমা। এর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো নিঃস্বার্থপরতার উদ্দেশ্য যেখানে অভিবাসীরা তাদের পরিবার-পরিজনদের জন্য অর্থ প্রেরণে উদ্বিগ্ন থাকে। অন্যদিকে, আয়ের পার্থক্য, স্বল্প মেয়াদে বিদেশে অবস্থান আর নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে প্রবাসী শ্রমিকদের উপার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করে বা জমিয়ে রাখার বিষয়ও উঠে এসেছে। এ কারণগুলো রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপর এক ধরনের প্রভাব ফেলে।

অস্থায়ী অভিবাসীরা উপার্জিত অর্থ পরিবারের ভরণ-পোষণে খরচের পাশাপাশি বিনিয়োগে খরচ করে। এদিকে স্থায়ীভাবে যারা বিদেশে বসবাস করে, তারা পরিবার-পরিজনের জন্য অর্থ পাঠায় কিন্তু দেশে বিনিয়োগে খুব একটা উৎসাহী থাকে না। তাছাড়া অস্থায়ী অভিবাসী শ্রমিকরা তাদের জীবন-জীবিকার জন্য বাইরের দেশে কাজ করে ঠিকই কিন্তু তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা থাকে দেশকে ঘিরে। কারণ ভবিষ্যতে তাদের নিজ দেশেই ফিরতে হবে। তাই তারা যতটা সম্ভব তাদের উপার্জনের অর্থ দেশে প্রেরণে উৎসাহী থাকে।

তবে প্রবাসীদের উপার্জিত অর্থ দেশে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো একটি সমস্যার সম্মুখীন। আর এটি হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ। বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকরা অনানুষ্ঠানিক এ চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ পাঠাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আমরা জানি, আন্তর্জাতিক বা জাতীয় বৈদেশিক মুদ্রা স্থানান্তর কাঠামোর বাইরে সম্পদের অবৈধ স্থানান্তরকে হুন্ডি বোঝায়। লন্ডন, নিউইয়র্ক, দুবাই, কুয়ালালামপুর ও সিঙ্গাপুরের মতো বিভিন্ন শহরে সংগঠিত গোষ্ঠী বাংলাদেশ কিংবা অন্যান্য অঞ্চলে হুন্ডি কার্যক্রম পরিচালনা করে। গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্ট (জিইপি)-২০০৬-এর প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে রেমিট্যান্সের ৫৬ শতাংশই আসে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে। তবে পরবর্তী সময়ে গ্রামীণ এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ বেড়েছে বা বলা যায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। রেমিট্যান্স স্থানান্তরের জন্য আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের ব্যবহার বৃদ্ধি হলেও সমস্যাটি কিন্তু এখনো রয়ে গেছে। তাছাড়া ভারতে আমাদের আস্থায়ী শ্রমিকদের অভিবাসনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে চিহ্নিত করা হয়নি। এখানে যেমন রাজনৈতিক ইস্যু রয়েছে, তেমনি পাশাপাশি দেশ হওয়ার কারণে অনেকেই অবৈধ পথে সীমান্ত দিয়ে আসা-যাওয়া করে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের অভিবাসীদের কাছ থেকে প্রেরিত অর্থ সম্ভবত অনানুষ্ঠানিক পথ অনুসরণ করে এবং রেমিট্যান্স হিসাবের বাইরেই থাকে। আমার মনে হয়, এটা শুধু হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ প্রদানকে গতিশীল করছে না, বরং বাণিজ্যের জন্য অর্থ সরবরাহের মাধ্যমে সীমান্ত পাচার ও চোরাচালানকেও উৎসাহিত করছে।

রেমিট্যান্সের ব্যবহার  উন্নয়ন ডায়নামিকস

বাংলাদেশের উন্নয়নের রেমিট্যান্সের প্রভাব কতটা তা বোঝার জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে ব্যাস্টিক ও সামস্টিক আর্থসামাজিক বিষয়গুলোর ওপর এর প্রভাব মূল্যায়ন করা যেতে পারে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দারিদ্র্য ও আর্থিক উন্নয়নে রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। প্রবাসী শ্রমিকদের বেশির ভাগই নিজে দেশে কর্মসংস্থানহীন অবস্থায় দিন কাটিয়েছে, প্রবাসে তারা চাকরি করছে। তবে এটি কিন্তু স্বদেশে অন্যদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগকে সীমিত করতে পারে বা কম সুযোগ তৈরি হতে পারে। বিপরীতে তাদের প্রেরিত রেমিট্যান্স নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে সহায়তাও করতে পারে। তবে এটি তখনই ঘটে, যখন রেমিট্যান্সের মাধ্যমে জাতীয় সঞ্চয়, পুঁজি ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়। তাই আমরা বলতে পারি, উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নে রেমিট্যান্স পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ উভয়ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

তবে আমি মনে করি, এটা নির্ভর করে রেমিট্যান্সের ব্যবহারের ওপর। বিশেষ করে এর মাধ্যমে একটি দেশের অর্থনীতি ও সমাজ কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। উন্নয়ন ও রেমিট্যান্সের মধ্যের যোগসূত্রটি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন আমাদের গবেষণার মাধ্যমে আমরা দেখতে পেয়েছি যে প্রেরিত প্রবাসী আয় মূলত ভোগ, সঞ্চয় ও বিনিয়োগে ব্যবহারিত হয়; ব্যক্তি পর্যায়ে কিংবা সম্মিলিতভাবে। তাছাড়া সঞ্চয়ের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে তারা কিছু উদ্যোক্তা কার্যক্রম শুরু করতেও উৎসাহিত থাকে। এ প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্স ব্যক্তিগত সুবিধাভোগীদের উদ্যোক্তা শক্তি বিকাশেও সহায়তা করে।

২০১৬ সালের খানা জরিপের তথ্য অনুযায়ী আমরা দেখি, ৮ দশমিক ২৭ শতাংশ খানার অন্তত একজন সদস্য প্রবাসী অভিবাসী। বিষয়টি স্বাভাবিক যে শহরের তুলনায় গ্রাম থেকে অভিবাসনের হারই বেশি। গ্রামের প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ৬৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ অর্থই ব্যয় হয়ে থাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার ক্ষেত্রে। এছাড়া ২৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ রেমিট্যান্স ব্যবহার হয় বিভিন্ন বিনিয়োগে, ২ দশমিক ১৩ শতাংশ বিভিন্ন টেকসই দ্রব্যের বিনিয়োগে এবং বাকি অংশ সঞ্চয়ে (বিবিএস, ২০১৯)।

বাংলাদেশের উন্নয়ন ডায়নামিকসে অভিবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, তা বিভিন্ন পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। তুলনামূলকভাবে দেখা গেছে, অভিবাসী আছে গ্রামের এমন খানাগুলোতে দারিদ্র্য হার কম এবং খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত খরচের পরিমাণ বেশি। এদিকে যেসব খানায় অভিবাসী নেই সেসব খানায় মাসিক ভোগ ব্যয় গড়ে ৩ হাজার ২০৯ টাকা। আর খাদ্য ব্যয় ১ হাজার ৬৮০ টাকা। যেসব খানায় প্রবাসী অভিবাসী রয়েছে তাদের মাসিক ভোগ ব্যয় ৫ হাজার ৪০৩ টাকা। খাদ্য ব্যয় ২ হাজার ৩৪৫ টাকা। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি দিয়ে আমরা অভিবাসীদের প্রেরিত অর্থ গ্রামীণ অর্থনীতি ও পরিবারগুলোতে কী ধরনের প্রভাব রাখে তা বুঝতে পারি। দারিদ্র্য বিমোচন ও খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের ক্ষেত্রে অভিবাসীদের পাঠানো অর্থের ভূমিকা অপরিসীম। অভিবাসীদের পাঠানো অর্থ শুধু তাদের নিজস্ব খানার আর্থসামাজিক অবস্থানের উন্নয়ন ছাড়াও বহুমাত্রিক প্রভাবে কারণে সার্বিকভাবে সমগ্র গ্রামীণ অর্থনীতিতে সঞ্চালিত হচ্ছে, যা স্বাভাবিকভাবেই গ্রামীণ অর্থনীতির চাকাকে বেগবান করতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়াও শিক্ষা কিংবা স্বাস্থ্যে অভিবাসী পরিবারগুলো অধিক বিনিয়োগ করে। ফলে দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষা, দক্ষতা ও সর্বোপরি মানবসম্পদ উন্নয়নে রেমিট্যান্সের ভূমিকা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ২০১৬-এর খানা জরিপের তথ্য অনুযায়ী যেখানে অভিবাসী খানায় শিক্ষাক্ষেত্রে বার্ষিক গড় ব্যয় ২৫ হাজার ৭৯৭ টাকা। এ সংখ্যা অন্যান্য খানায় (যেখানে কোনো অভিবাসী সদস্য নেই) ১৬ হাজার ২২২ টাকা মাত্র।

গত পাঁচ দশকে দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। গ্রামের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে তা দৃশ্যমান। তাছাড়া গত পাঁচ দশকের রেমিট্যান্স প্রবাহের দিকে আলোকপাত করলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ ছিল ২৩ দশমিক ৭১ মিলিয়ন ডলার। ২০০০ সালে আমাদের প্রবাসী আয় বেড়ে পৌঁছে ১ হাজার ৯৫৪ দশমিক ৯৫ ডলারে। ২০১৯ সালের যা ছিল ১৮ হাজার ৩৫৪ দশমিক ৯৪ ডলার। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের হিসাব অনুযায়ী প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ২ হাজার ১৫১ দশমিক শূন্য ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সামষ্টিক অর্থনীতির সাপেক্ষে রেমিট্যান্সের অবদান জাতীয় আয়ের ৬ শতাংশেরও বেশি।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০ দেশের একটি। বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করতে গেছেন। এ প্রবাসীরা মূলত স্বল্পশিক্ষিত। মূলত তারা গ্রামের বাসিন্দা। যারা গত সাড়ে চার দশকে ২ লাখ ১৭ হাজার মিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় পাঠিয়েছেন। বছরে এখন তারা ১৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছেন। প্রবাসীদের প্রেরিত এ আয়ের কারণে নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যেই বেশ কয়েকটি নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ।

দেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের ভূমিকা ক্রমেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। দারিদ্র্য হ্রাস, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তুলতে রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ অবদান আরো বেড়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে রেমিট্যান্সের অংশ ছিল ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ।

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেকর্ড ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠান প্রবাসীরা। এরপর আগস্টেও ১৯৬ কোটি ৩৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে আসে। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স ২ বিলিয়ন ডলারের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে ২১৫ কোটি ১০ লাখ ডলারে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসীরা ৬৭১ কোটি ৩১ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ৪৫১ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

বৈধ চ্যানেলে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রধান মাধ্যম ব্যাংক খাত। সেপ্টেম্বরে দেশের ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ২১৫ কোটি ১০ লাখ ডলার। শুধু চলতি বছরই নয়, রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি কয়েক বছর ধরেই অব্যাহতভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ১ হাজার ৮২০ কোটি ৫০ লাখ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ হাজার ৬৪১ কোটি ৯৬ লাখ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ হাজার ৪৯৮ কোটি ১৬ লাখ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১ হাজার ২৭৬ কোটি ৯৪ লাখ ডলার।

বিএমইটির তথ্য বলছে, বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি মূলত মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক। গত বছর (২০১৯) বিদেশে যাওয়া মোট কর্মীর ৯০ শতাংশ গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। শুধু সৌদি আরবে গেছেন ৫৭ শতাংশ কর্মী। গত বছর বিভিন্ন দেশে গিয়েছিলেন প্রায় সাত লাখ কর্মী। এর মধ্যে ৩ লাখ ৯৯ হাজার গেছেন সৌদি আরবে। এছাড়া ওমানে ৭২ হাজার ৬৫৪ জন, কাতারে ৫০ হাজার ২৯২ ও সিঙ্গাপুরে ৪৯ হাজার ৮২৯ জন কর্মী গিয়েছিলেন। গত বছর বিদেশে যাওয়া কর্মীদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ ছিলেন দক্ষ কর্মী। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে দক্ষ কর্মী গিয়েছিলেন ৪৩ শতাংশ।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) বলছে, ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হবে। শুধু যে শহরেই উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে তা-ই নয়। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিও এখন বেশ শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে। সচ্ছলতা ফিরেছে গ্রামের মানুষের, বিদেশ থেকে আসা অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। পুষ্টি ঘাটতি পূরণ হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে কর্মচাঞ্চল্য ও গতিশীলতা সৃষ্টিতে প্রবাসী আয় বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। মানুষের জীবনমান আর গ্রামগুলোর বদলে যাওয়ার নেপথ্যে বৈদেশিক কর্মসংস্থান বা প্রবাসী আয়ের বড় ধরনের অনুঘটক।

এটাও স্বীকার করতে হবে যে বিশ্ব দ্রুত পাল্টাচ্ছে। বাজারে নতুন নতুন চাহিদা তৈরি হচ্ছে। কভিড-১৯ পরিস্থিতি আমাদের অর্থনীতিকে নতুন এক পরীক্ষার সম্মুখীন করেছে। প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির ফলে নতুন নতুন সম্ভাবনার পাশাপাশি বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমাদের। এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের দক্ষতা ও সক্ষমতার নতুন পরীক্ষা দিতে হচ্ছে সবাইকে। সরকার ও নীতিনির্দেশকদের এখন তাই আরো দূরদর্শী হতে হবে, আরো দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তার পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। এ নতুন পথযাত্রায় আমরা অবশ্যই অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করব। তাই গত ৫০ বছর বিভিন্ন সরকার যে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে, তা আমরা স্বীকার করব, সেই পদক্ষেপগুলো পর্যালোচনা করব, সেসব নীতি প্রণয়নের পটভূমি ও অভিঘাত বোঝার চেষ্টা করব।