বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ হ্রাসের ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ কাজ করেছে। বিশেষ করে ১৯৯০ সালের স্বৈরশাসকের পতনের পর থেকে এই প্রবণতা লক্ষণীয়।
নিম্নে প্রধান কারণগুলো তুলে ধরা হলো:
১. আন্তর্জাতিক শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ (UN Peacekeeping Missions)
- পেশাগত সুবিধা ও মর্যাদা: বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা বিশ্বজুড়ে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এই অংশগ্রহণ তাদের জন্য পেশাগত দক্ষতা অর্জন, আন্তর্জাতিক পরিচিতি বৃদ্ধি এবং আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করে।
- প্রতিষ্ঠানিক অগ্রাধিকারের পরিবর্তন: শান্তি মিশনে সফলতার কারণে সামরিক বাহিনীর মনোযোগ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে পেশাগত দায়িত্ব ও আন্তর্জাতিক ভূমিকায় স্থানান্তরিত হয়েছে।
- রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের নিরুৎসাহ: সরাসরি রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করলে আন্তর্জাতিকভাবে বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে পারে এবং লাভজনক শান্তি মিশনে অংশগ্রহণের সুযোগ হারানোর ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এই সম্ভাবনা সামরিক বাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে উৎসাহিত করে।
২. গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুসংহতকরণ ও জনগণের সচেতনতা
- গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের আকাঙ্ক্ষা: সামরিক শাসনের খারাপ ফল (যেমন: অর্থনৈতিক ক্ষতি, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা, সংবিধান লঙ্ঘন) সম্পর্কে জনগণের অভিজ্ঞতা বেড়েছে এবং গণতন্ত্রের প্রতি তাদের সমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছে। সামরিক হস্তক্ষেপকে এখন বেশিরভাগ জনগণই নেতিবাচক চোখে দেখে।
- সংবিধানিক পরিবর্তন: ১৯৯১ সালে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন এবং পরবর্তীকালে সংবিধানের বিভিন্ন সংশোধনী সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের সুযোগকে সংকুচিত করেছে।
৩. সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি
- ঐতিহাসিক তিক্ত অভিজ্ঞতা: বারবার সামরিক অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থানের কারণে সৃষ্ট রক্তপাত ও অস্থিরতা সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে বিভেদ ও অস্থিরতা তৈরি করেছিল। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সামরিক নেতৃত্ব অভ্যন্তরীণ সংহতি এবং পেশাদারিত্ব বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে।
- সামরিক নেতৃত্বের ভূমিকা: সামরিক বাহিনীর পেশাদার নেতৃত্ব রাজনীতিতে সরাসরি জড়ানো থেকে বিরত থাকার দৃঢ় মনোভাব পোষণ করেছে। তারা মনে করে, একজন সৈনিকের রাজনীতিতে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়।
৪. অর্থনৈতিক ও বেসামরিক ক্ষেত্রে বাহিনীর সম্পৃক্ততা
- বেসামরিক কাঠামোয় অর্থনৈতিক ভূমিকা: সামরিক বাহিনী এখন বিভিন্ন বেসামরিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছে (যেমন: অবকাঠামো নির্মাণ, কল্যাণমূলক ট্রাস্ট পরিচালনা)। এর ফলে তাদের প্রভাব বা সম্পদের উৎসের জন্য সরাসরি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ওপর নির্ভরতা কমেছে।
উপসংহারে বলা যায়, আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা, আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি জনগণের সমর্থন এবং সামরিক বাহিনীর নিজেদের পেশাদারিত্ব বজায় রাখার আকাঙ্ক্ষার মতো সম্মিলিত কারণগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপকে বহুলাংশে হ্রাস করেছে।
আর কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা কারণ সম্পর্কে জানতে চান?


