উত্তর:ভূমিকা: বাংলাদেশ মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যায় নানাভাবে জর্জরিত। এসব সমস্যা একবারে বা একদিনে সমাধান করা সম্ভব নয়। তবে পর্যায় ক্রমে ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনায় তা সমাধান সম্ভব। নিম্নে এসব মৌলিক সমস্যা সমাধানের কতিপয় সুপারিশ করা হলো:
১. কৃষিখাতের উন্নয়ন: বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান খাত কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধিত হলে সমগ্র অর্থনীতিতে অনুকূল প্রভাব সৃষ্টি হবে। যুগোপযোগী পরিবর্তন ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে এ খাতের উন্নয়ন সাধন করা যায়।
২. শিল্পের উন্নয়ন:কৃষির পাশাপাশি শিল্পের উন্নয়ন বাংলাদেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি এবং বেকারত্ব হ্রাস করবে। এজন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু শিল্পনীতি প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন, শিল্প ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও শিল্প বিনিয়োগ বৃদ্ধি।
৩. সঞ্চয় বৃদ্ধি ও মূলধন গঠন: যে-কোনো দেশের উন্নয়ন কাঠামো শক্ত ও মজবুত করতে হলে পর্যাপ্ত মূলধন দরকার হয়। বাংলাদেশে তা নেই। এদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় কম, ফলে সঞ্চয় কম। এ সঞ্চয় প্রবণতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ সঞ্চয় সমাকলনের মাধ্যমে বৃহৎ প্রকল্প ভিত্তিক পুঁজি গঠনে সাহায্য করতে হবে।
৪. উন্নত অর্থনৈতিক অবকাঠামো সৃষ্টিঃ অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে উন্নত অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামোর উপস্থিতি। বাংলাদেশে যোগাযোগ, পরিবহন, পানিশক্তি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ, সেচ, বাধ নির্মাণ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা প্রভৃতি সম্প্রসারিত ও উন্নত করতে হবে।
৫. শিক্ষার প্রসারঃ বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত ও অজ্ঞ। এজন্য দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি খুবই মন্তর। এমতাবস্থায় দেশের বর্তমান সমস্যাবলির সমাধান তথা দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষার ব্যাপক প্রসায় ঘটাতে হবে।
৬. প্রাকৃতিক সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার: বাংলাদেশে প্রচুর প্রাকতিক সম্পদ রয়েছে। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনার অভাবে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার সম্ভব হচেছ না। সুতরাং সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের জাতীয় উৎপাদন তথা অর্থনৈতিক অগ্রগতির হার বৃদ্ধি করতে হবে।
৭. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ: পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশে উচ্চ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করতে হবে। এর ফলে বেকার সমস্যা হ্রাস ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে প্রতিকূলতা দূর হবে।
৮. কারিগরি জ্ঞানের উন্নতি: শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশে কারিগরি জ্ঞানের উন্নয়ন সাধিত হলে জনশক্তির দক্ষতা বাড়বে। এতে উৎপাদনের পরিমাণ ও মান বৃদ্ধি পাবে।।
৯. বেকারত্বরোধ: বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সুবিধা বাড়াতে হবে। ছোট বড় কুটির শিল্প ও বৃহৎ শিল্প স্থাপন করে এ সমস্যা সমাধান করা যায়।
১০. বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস: বাংলাদেশের উন্নয়ন কাঠামো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। বৈদেশিক শর্তযুক্ত সাহায্য অবশ্যই পরিহার করা দরকার। নচেৎ উন্নয়নের মূল সাহায্য দাতা শর্ত যুক্ত সাহায্য দ্বারা খেয়ে ফেলবে।
১১. মুদ্রাস্ফীতি রোধঃ স্বাধীনতার পর নানা কারণে মুদ্রাস্ফীতি জনজীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সকল প্রচেষ্টা ব্যাহত করছে। এরূপ অবস্থায় আর্থিক ও রাজস্ব ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের মুদ্রাস্ফীতি প্রতিরোধের জন্য আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১২. বৈদেশিক বাণিজ্যের উন্নয়নঃ একদিকে রপ্তানি বাণিজ্যের বিকেন্দ্রীকরণ ও রপ্তানি বৃদ্ধি এবং অনাবশ্যক ও ক্ষতিকর দ্রব্যের আমদানি রোধ করে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি হ্রাস করা যায়। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার যে সাশ্রয় হবে তা উন্নয়ন কাজে ব্যয়িত হতে পারে।
১৩. দুর্নীতি রোধ: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির স্বার্থে সমাজ দেহ হতে সব ধরনের দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে হবে। এর ফলে প্রশাসন গতিশীল হবে এবং অর্থনৈতিক সমস্যাবলি দ্রুত সমাধান সম্ভব হবে।
১৪. সুষ্ঠু পরিকল্পনা: বাংলাদেশে সুষ্ঠু উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমস্যাবলি বহুলাংশে হ্রাস করা যায়।সম্পদের যথাযথ ব্যবহার এবং সুষম বণ্টন ব্যবস্থার ভিত্তিতে রচিত উন্নয়ন পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন একান্ত প্রয়োজন।
১৫. বন্যা নিয়ন্ত্রণ : বন্যা আমাদের বর্তমান দূরাবস্থার অন্যতম কারণ। সুতরাং সর্বনাশা বন্যার কবল থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১৬. প্রশাসন ব্যবস্থার উন্নয়ন: বাংলাদেশে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার সফল বাস্তবায়নের স্বার্থে প্রশাসন কাঠামো জনকল্যাণমূলক ও দক্ষ হওয়া বাঞ্ছনীয়। শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি ক্ষেত্রের সমস্যাবলি প্রশাসনিক দক্ষতার দ্বারা হ্রাস করা সম্ভব।
১৭. অব্যাহত উন্নয়ন প্রচেষ্টা: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমস্যাবলির সমাধানের জন্য অব্যাহত উন্নয়ন প্রচেষ্ট। প্রয়োজন। এ উদ্দেশ্যে যথাযথ রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে পরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রম চালানো উচিত।
১৮. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাঃ যে-কোনো দেশের উন্নয়ন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দ্বারা প্রভাবিত হয়। বিরোধী রাজনৈতিক অস্থিরতা জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। এ দ্বারা উন্নয়ন ব্যাঘাত ঘটে।
১৯. খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনঃ বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৫ থেকে ৩৫ লক্ষ টন খাদ্য আমদানি করতে হয়। যার ফলে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থায় খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা একান্ত প্রয়োজন। উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশের মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যাবলি সমাধানে প্রয়োজন সার্বিকভাবে জনসাধারণের সহায়তা, নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি, সত্যনিষ্ঠ ও গভীর দেশ প্রেম।