বাংলাদেশের মৌলবাদ বিরোধী সংগ্রামে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের অবদান আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশে মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ভূমিকা বিশ্লেষণ কর।
অথবা, বাংলাদেশের মৌলবাদ বিরোধী সংগ্রামে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের অবদান বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ভূমিকা আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলার মানুষ সংগ্রামের ইতিহাস ভুলে গিয়ে সবকিছু সইতে শুরু করেছিল, এমন সময় আমাদের চৈতন্যে আঘাত করলেন এক মহীয়সী নারী, যিনি আমাদের অতি পরিচিত জাহানারা ইমাম, যাকে আমরা ‘শহীদ জননী’ বলে ডাকি। তিনি প্রত্যয়দৃপ্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত নতুন এক লড়াইয়ের প্রধান সেনাপতি, বাংলার সকল মানুষের শহীদ জননী বীরমাতা জাহানারা ইমাম, যিনি আজীবন মৌলবাদ বিরোধী সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন।
মৌলবাদ বিরোধী সংগ্রামে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের অবদান : বাঙালি জাতিকে নতুন পথনির্দেশক করে এ মহান নেত্রী সূচনা করেছিলেন এক নতুন মুক্তিযুদ্ধের, যে যুদ্ধ জয় আমাদের আজও সম্পন্ন হয়নি এবং যে বিজয় আমাদের অনিবার্য। মৌলবাদ বিরোধী সংগ্রামী শহীদ জননী জাহানারা ইমামের অবদান নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. স্বাধীনতা বিরোধীদের দমন: জাহানারা ইমাম ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে বলেছিলেন যে, স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত শিবির চক্র আজও রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরে স্বাধীনতা ও বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তাই বাঙালি জাতির অংশ হিসেবে, গৌরবদীপ্ত অতীতের সংগ্রাম সংকল্পবদ্ধ ইতিহাস বুকে ধারণ করে আমরা প্রায় ১৪ কোটি মানুষ বেঁচে আছি সোনার বাংলা গড়ে জননীর সূচিত গণআন্দোলনের সফল বিজয় স্তম্ভ রচনার নিয়ত যুদ্ধে। এদের দমন করতে তিনি “ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি” গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
২. বাংলার মানুষের প্রাণে স্পন্দন সৃষ্টি : শহীদ জননী সূচিত গণআন্দোলন বাংলার মানুষের প্রাণে যে স্পন্দন সৃষ্টি করেছিল, তাকে আজ আবার জাগ্রত করতে হবে, করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, সৎ ও দেশপ্রেমিক জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে। তবে এজন্য তৎপর গণঐক্যের দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তুলতে হবে বাংলার মানুষের। তবেই বিনাশ হবে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির এবং এভাবেই শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করা হবে। আবার সমাজ পাবে মুক্ত সাধারণ জনগণ।
৩. সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গণআন্দোলন : শহীদ জননীর প্রয়াস উপলক্ষে সকলকে নবীন প্রয়াসে উদ্দীপিত হতে হবে। জামায়াত, শিবির, রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ সকল ঘাতক দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে, যতদিন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে রাহুমুক্ত করতে না পারব, ততদিন সচেতন প্রচেষ্টা যেন অব্যাহত থাকে শহীদ জননী সূচিত মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গণআন্দোলন।
৪. সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী নাগরিক কমিটি : ১৯৮০ সালে জাহানারা ইমাম জামাত, ফ্যাসিবাদ ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী নাগরিক কমিটি’ গঠন করলেন। এ সংগঠন প্রণয়নে প্রগতিশীল চিন্তা চৈতন্যে উদ্বুদ্ধ এবং মুক্ত বাংলাদেশের সচেতন কিছু বাঙালিই এ উদ্যোগ নিলেন। ১৯৮১ সালের ২৫ মে বায়তুল
মোকাররমের দক্ষিণের স্টেডিয়াম গেটে এ কমিটিই এক জনসমাবেশের আয়োজন করে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এ সভায় ঘোষণা দেন যে, মাগো তোমায় কথা দিলাম, অস্ত্র আবার হাতে নেব, মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার। তার চেতনায় জাগ্রত করেছে প্রগতিশীল জনগণকে।
৫. অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকতা বিরোধী আন্দোলন : বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি গোলাম আযমের আমিরত্বকে মেনে নিতে পারে নি। তাই জামায়াত বিরোধী কমিটি গঠন করা হলো। এ কমিটির প্রধান হিসেবে বেগম সুফিয়া কামালকে আহ্বায়ক হিসেবে প্রস্তাব দিলে তিনি অসুস্থতার কথা বলে জাহানারা ইমামকে বেছে নেয়ার প্রস্তাব দেন। অবশেষে জাহানারা ইমাম হন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক এবং ১০১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটিতে বামপন্থি প্রগতিশীলদের প্রাধান্য ছিল লক্ষণীয়।
৬. জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন : জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ সালে। মূলত এ কমিটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এ দু’য়ের সমন্বয়সাধন করে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে বাংলার আপামর জনসাধারণের ঘৃণাকে আরো শক্তিশালী করে প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে এবং বেগবান আন্দোলন সৃষ্টি করে অধ্যাপক গোলাম আযমসহ ঘাতকদের বিচার ও শাস্তি বিধানের তাগিদেই কমিটির উদ্ভব হয়। তাই এ জাতীয় সমন্বয় কমিটি ছিল ৭০টি সংগঠনের একটি প্রতিনিধিত্বশীল। কিন্তু এর ঐক্য কখনো কখনো জনমনে সংশয় সৃষ্টি করেছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আত্মসমালোচনা করেই বলা যায় সূচিত সংগ্রামের বিপুল গণজাগরণ মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে। জামাত, শিবিরকে জাতীয় সংসদে জাহানারা ইমাম জীবিত থাকতে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সে জাগ্রত জনগোষ্ঠীর সাহসী নেতৃত্ব যেন আজ স্তিমিত, ক্লান্ত। ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রেখে কর্মসূচি অব্যাহত থাকলেও যেন সে তোড় হারিয়েছে প্লাবনের উচ্ছ্বাস। ঘন সমুদ্রে যে উত্তাল তরঙ্গ রক্ত স্বাক্ষরের সীমন্তিনী এ বাংলার জনপদে মানুষকে জাগিয়ে দিয়েছিল, নিজ কর্তব্য পালনের অঙ্গীকারে শত্রু হননের বিপুল প্রত্যাশায়, সে কি আজ গুমোট মেঘের আড়ালে সূর্যের মতো ঢেকে যাবে? শহীদ জননীর শেষ প্রার্থনার আবেগে উদ্বেলিত জনমণ্ডলীর বজ্র নির্ঘোষ কর্মসূচি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে বাধ্য করবে ক্ষমতাসীন সরকার। নিষিদ্ধ হোক ধর্মব্যবসায় ধর্মান্ধ রাজনীতি এটাই সবার কামনা।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a4%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%be-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4%e0%a6%bf/