বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক পটভূমি আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক পটভূমি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাংস্কৃতিক পটভূমি নিরূপণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রাম একদিনের ইতিহাস নয়। এটা ছিল বাঙালির আজন্ম লালিত স্বপ্ন। এ মুক্তিযুদ্ধের পিছনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি দীর্ঘদীনের চাপানো বিভিন্ন বৈষম্য ও শোষণ কাজ করেছে। এ বৈষম্য ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক তথা সমস্ত দিক থেকে বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে। এসব
পটভূমিগুলোর প্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। সাংস্কৃতিক পটভূমি : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক পটভূমি প্রথম রচিত হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে। এ আন্দোলন মূলত একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও এর রাজনৈতিক দিকটাকে মোটেই উপেক্ষা করা যায় না। বাঙালির প্রাণের ভাষা, মায়ের ভাষা বাংলা ভাষার প্রতি ষড়যন্ত্রের প্রথম সূত্রপাত ঘটে ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর প্রথম সফরে যখন ঢাকার রমনার রেসকোর্সে এক জনসভায় ঘোষণা করেন : “উর্দু এবং কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।” (Urdu and only Urdu, shall be the state language of
Pakistan.) এ আন্দোলনের প্রতিবাদে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদের ঝড় উঠে এবং এ সাংস্কৃতিক আন্দোলন ক্রমেই বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ নেয়। রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সর্বপ্রথম পরিকল্পিত ও সুসংগঠিত আন্দোলন শুরু করে পাকিস্ত নি তমদ্দুন মজলিস। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার মাত্র ১৭ দিনের মাথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
তরুণ অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে ১ সেপ্টেম্বর ৩ সদস্যবিশিষ্ট এ “তমদ্দুন মজলিস”। অবশ্য ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তখন পাকিস্তানের তদানীন্তন গভর্নর
জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দীন জিন্নাহর ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করে বলেছেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা সে সময় এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। অবশেষে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারদের রক্তের বিনিময়ে রক্ষিত হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলার সম্মান। বর্তমানে এ ভাষা আন্দোলনের মহান ২১ ফেব্রুয়ারি আজ বিশ্বের ১৮৮টি দেশে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে পালিত হচ্ছে।
ভাষা আন্দোলন বাঙালি সমাজকে একটি প্লাট ফরমে এনে দেয়, যার মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতি তথা বাঙালি জাতীয়তাবোধ জাগ্রত বাংলার আপামর জনতা মুক্তির জন্য সংগ্রাম করতে শুরু করে।
আন্দোলনকারীদের মিছিল ও বিক্ষোভ কেবলমাত্র ঢাকা শহরে সীমাবদ্ধ ছিল না, তা পূর্ব বাংলার গ্রামেগঞ্জে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। এভাবে সমাজের সর্বস্তরের জনগণের এক নতুন শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে উঠে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ‘‘বাঙালি এলিট’ শ্রেণিকে প্রয়োজনীয় গণ আবেদন এবং
গোষ্ঠী সংহতিও প্রদান করে। পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানকে তাদের উপনিবেশ হিসেবে গড়ে
তুলতে চেষ্টা করে। সে উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে তারা প্রথমেই বাংলা ভাষার উপর আঘাত হানে। আর ১৯৫২ সালে রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে বাঙালি জাতি সর্বপ্রথম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হয়। ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে ধাপে ও স্তরে স্তরে প্রেরণা যুগিয়েছে
ভাষা আন্দোলনের রক্তরাঙা ইতিহাস। সুতরাং বলা যায়, ভাষা আন্দোলন সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও এ আন্দোলনের ফলেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের রিকাশ ঘটে, প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত বক্তব্যের আলোকে বলা যায় যে, ১৯৭১ সালের বাঙালির আজন্ম লালিত স্বপ্ন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয় তার মূল কারণ ছিল বাঙালি জাতির জাতীয়তাবোধ চেতনা, যার প্রথম পটভূমি রচিত হয় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে। এ ভাষার দাবি মূলত একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও শেষপর্যায়ে এটি বাঙালির
অধিকার আদায়ের প্রধান দাবিতে পরিণত হয়, যার ফলে ১৯৭১ সালে এটি স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।