অথবা, বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনগুলোতে নারীকে কিভাবে উপস্থাপন করা হয়? বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনগুলোতে নারীকে উপস্থাপন করা হয়? এ সম্পর্কে আলোকপাত কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বর্তমানের বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ের মুদ্রণ ও ইলেকট্রনিক সব মাধ্যমেই বিজ্ঞাপনের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বস্তুত বর্তমান সময়ে পাঠক, দর্শকের দেওয়া মূল্য আর মিডিয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রদেয় অর্থের উপরই মিডিয়াগুলো টিকে থাকে ও মুনাফা করে। তাই মিডিয়ায় ব্যাপক দাপট নিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়ে থাকে। মিডিয়ার অন্যতম উপাদান বিজ্ঞাপনে নারীর অপরূপায়ণ দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য মাধ্যমের তুলনায় বিজ্ঞাপনে নারীরা অংশগ্রহণ অনেক বেশি, কিন্তু অংশগ্রহণ বেশি হলেও এখানে নারীকে উপস্থাপন করা হয় নেতিবাচকভাবে।
বিজ্ঞাপনে নারীর উপস্থাপন : গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ মার্শাল ম্যাকলুহান বিজ্ঞাপনকে ‘নারীকে আলিঙ্গনরত পুরুষের শাস্ত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। (Mcluhan, 1964: 226) বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য হল পণ্যের গুণাগুণ বর্ণনার মাধ্যমে পণ্যটি সম্পর্কে অডিয়েন্সকে আকর্ষণ করা। বিজ্ঞাপন শাস্ত্রে আছে সফল বিজ্ঞাপন নির্মাণ করতে হলে মানুষের মৌল
প্রবৃত্তি ও বাসনাকে নাড়া দিতে হবে। অর্থলাভ, সচ্ছলতা অর্জন মানুষের অন্যতম বাসনা এবং যৌনতা মানুষের অন্যতম প্রকৃতি। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এসব বাসনা ও প্রবৃত্তিকে নাড়া দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়। এ কারণে নারী মুখ ও নারী শরীরকে ব্যবহার করা হয়, পুরুষ অডিয়েন্সকে আকৃষ্ট করার জন্য। যার ফলে বিজ্ঞাপনগুলোতে নারীর অবস্থান হয় সমাজে বিদ্যমান ধ্যানধারণার চেয়েও আরও বেশি অধস্তন, সে হয়ে দাঁড়ায় যৌনতার প্রতীক। বিজ্ঞাপনে নারীকে কিভাবে উপস্থাপন করা হয় নিম্নে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. ভোক্তা ও ভোগ্যা : অবস্থাটি এ রকম যে, নারী ছাড়া বিজ্ঞাপনকে আলাদা করে দেখা অসম্ভব। তাঁর গবেষণায় ৪৭.১৯ শতাংশ পণ্যের বিজ্ঞাপনে নারীই মূল ভোক্তা এবং বিজ্ঞাপন চিত্রের প্রধান চরিত্রের ৫৩ শতাংশ ক্ষেত্রেই তার উপস্থিতি। নারী চাঁদমুখ থেকে দাগ তোলেন, ভালোবাসার অর্থ খোঁজে পান নারকেল তেলে, ভাবী শাশুড়ি ভজানোর মন্ত্র
খোঁজেন উকুননাশক শ্যাম্পুতে, নিজ পরিবারের জন্য মজাদার খাবার রান্না করেন বা অপরের পরিবারের সুরক্ষা কামনা করেন। ৪৫.৮২ শতাংশ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ব্যবহার্য জিনিসের বিজ্ঞাপনেও তার অদম্য উপস্থিতি। বিজ্ঞাপনদাতাদের নারীদের সম্ভাব্য ক্রেতা হিসেবে টার্গেট করার কারণ হল বর্তমানে নারীরাই গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি গৃহস্থালির সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে থাকে। শুধু ক্রেতা হিসেবে দেখা হয় না, পর্দার বা পর্দার সামনের পুরুষের দৃষ্টিক্ষেপণ, আকর্ষণ, বিনোদন ও অনুমোদনের অপেক্ষায় বিজ্ঞাপনে নারীরা আবর্তিত হয়। নারী তাই সক্রিয় বা মূল ক্রেতা থাকে না। মূল ক্রেতা ও ভোক্তা হয় পুরুষ, যার তুষ্টির জন্য নারী হয় বিক্রীত ও বিকৃত। বিজ্ঞাপন কিভাবে চিত্রিত করে নারীকে? বিজ্ঞাপন নারীকে শুধু পণ্যে পরিণত করে না, পরিণত করে পুরুষের কামনা উদ্রেককারী পণ্যে। ব্যবহার করে পুরুষের যৌনতাবোধ- প্রশ্রয় দেয় যৌনতাযুক্ত সামগ্রী দর্শনে। সিক্ত দেহ, মদির চাহনি, উত্তেজক ওষ্ঠভঙ্গিমা ও ইঙ্গিতপূর্ণ বাক্যে বিজ্ঞাপনের নারী সাবান বা স্নো ফেরি করে পর্দায়। তার সমগ্র অস্তিত্ব শুধু পুরুষের মনোরঞ্জন করার জন্যেই। পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি করার জন্যে পুরুষের চাহিদা বাড়িয়ে তোলা হয় এভাবে। শুধু সুন্দর নয় নারীকে হতে হবে ‘আরও সুন্দর’। কমনীয় ও কাম্য উৎসাহিত করা হয় ‘আরও কোমল আরও মসৃণ’ ত্বকের আবেশ বা সংস্কার সৃষ্টির। বিজ্ঞাপন নারীর সর্বস্বকে ফর্সা রঙ, রেশমি কালো চুল বা সজীব
ঠোঁটেই শুধু সীমিত করে দেয় না, নারীদের ভাবতে শেখায় এ সবের অনুপস্থিতে একজন নারী অসম্পূর্ণ ।
৩. এবার আমারও বিয়ে হবে : বিজ্ঞাপন শেখায় একজন নারীর জীবনের লক্ষ্য কি হওয়া উচিত। বিভিন্ন বিজ্ঞাপন থেকে এ তথ্য লাভ করা যায় যে, পুরুষের কাছে বঞ্চিত হওয়াই নারীর ধ্যান, জ্ঞান, উদ্বাহু বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া তার জীবনের লক্ষ্য এবং পুরুষের নজর কাড়তে পারা তার সবচেয়ে গৌরবময় কৃতিত্ব। ত্বক ফর্সা হলে পাওয়া যাবে জীবনের সেরা পুরস্কার, রূপমুগ্ধ পুরুষের পাঠানো গোলাপ বা বরপক্ষের পছন্দসই হতে পারা। পুরুষের কৃপাদৃষ্টি পেলে চমক লাগে নারী ভাগ্যে। শুষ্ক ঠোঁটকে মোলায়েম করে তুলতে পারলে মাছের মত ধরা পড়তে পারে পুরুষের জালে।
৪. স্বামীরা তো এ রকমই হয় : স্বামী-স্ত্রীর ক্ষমতা সম্পর্কের বৈধকরণ ও স্ত্রীর অধস্তন অবস্থানের স্বাভাবিকীকরণের দায়িত্ব নেয় বিজ্ঞাপন। উদাসীন স্বামীর ব্যস্ত জীবনের এক প্রান্তে পড়ে থাকা স্ত্রীর জীবনের একমাত্র কাজ স্বামীর মনোরঞ্জন । বন্ধ্যা স্বামীর কাছে স্ত্রীর আর কোন মূল্য নেই, শুধুমাত্র গায়ের রঙ আরও ফর্সা এবং ত্বক দাগমুক্ত হলেই স্বামীর নজরে স্ত্রীটি পড়তে পারে, এ ধরনের অত্যন্ত আপত্তিকর বক্তব্য বিজ্ঞাপন নির্বিবাদে প্রচার করে প্রতিনিয়ত। পুরুষকে শেখায় নারীকে মানুষ হিসেবে নয়, গায়ের রঙের মাপকাঠিতে মূল্যায়ন করতে আর নারীকে শেখায় এ অবমূল্যায়নকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে পুরুষের সামান্য কৃপাদৃষ্টিতেই আত্মহারা হয়ে উঠতে। নারীর অবমূল্যায়নের সঙ্গেই আসে তার কাজের অবমূল্যায়ন। নারীর গৃহশ্রমের মূল্য দেওয়ার বদলে নারী ও তার কাজ উভয়কেই তাচ্ছিল্য করতে শেখায় বিজ্ঞাপন।
৫. রোমান্টিক হয়রানি : যৌন হয়রানি নারীকে সন্ত্রস্ত করে, এ আশংকায় তার চলাফেরা সীমিত হয়, সমাজে তার পূর্ণ অংশগ্রহণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। যৌন হয়রানি নিঃসন্দেহে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ যৌন হয়রানিকে মদদ দেয় বিজ্ঞাপন । যেমন— উইন্টার গার্ড লিপজেলের বিজ্ঞাপনের আনন্দ মিছিলে একটি মেয়েকে ধরে তার ফাটা ঠোঁট নিয়ে ঠাট্টা আর হুল্লোড়ে মেতে উঠে একদল তরুণ। যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন না করে তুলে এ লাঞ্ছনাকে স্বতঃস্ফূর্ত তরুণের বহিঃপ্রকাশ বলে ভাবতে শেখানো হয়। ‘বেশ করেছি খোঁপা খুলেছি; চুল ছুঁয়েছি ছোঁবই তো। তোমার এ রেশমি কালো চুল দেখে পাগল আমি হবোই তো” বলে নারীর কেশ বা গাত্র স্পর্শ করে যে উন্মত্ততা প্রকাশ করা হয়, তাতে তো কোন রোমান্স নেই, বরং এটিও যৌন হয়রানির শামিল।
৬. মেহনতি পুরুষ ও রূপবতী নারী : নারী ও পুরুষের গৎবাঁধা বৈশিষ্ট্য বার বার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে বিজ্ঞাপন। নারী ও পুরুষকে উপস্থাপিত করে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির দুই মেরুর প্রজাতি হিসেবে। ধারণা তৈরি করা হয়- পুরুষের হাতে কর্তৃত্ব, তারা রোমাঞ্চপ্রিয়, সাহসী, উদ্যোগী, বহির্মুখী, নারী কোমল, পুরুষনির্ভর, লজ্জাবতী, প্রসাধনপ্রিয়, গৃহমুখী।
৭. প্রতীকী নিশ্চিহ্নকরণ : বিজ্ঞাপনে নারীর কোন রাজনৈতিক, বুদ্ধিভিত্তিক বা পেশাগত ক্ষমতা নেই। সে কোমল, শিশুসুলভ, নির্ভরশীল, সরল, সেবিকা, সহনশীল। বিজ্ঞাপন অস্বীকার করে সেসব নারীদের, যারা কাজ করেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখেন, প্রতিবাদে উচ্চকিত হন। চোখ বন্ধ করে থাকে সেসব দৃষ্টান্ত থেকে যেখানে নারী সময় ব্যয় করে সৌন্দর্য চর্চায় নয়, বুদ্ধির চর্চায়; চেহারায় নয় জ্ঞানের বিকাশে। সুগৃহিণী বা দেহসর্বস্ব হয়ে পুরুষের মন জয় করাকেই নারীর সাফল্য বলে প্রচার করে। নারীর স্থান গৃহে নির্দিষ্ট করে দিয়ে তার জীবনকে গৃহকেন্দ্রিক করে তোলে। সামগ্রিকভাবে বিজ্ঞাপনে নারীর উপস্থাপন নেতিবাচক।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের সিংহভাগ বিজ্ঞাপনে নারীকে যেভা
বে উপস্থাপন করা হয়, তা শুধু গৎবাঁধা এবং খণ্ডিতই নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে রীতিমতো সম্মানহানিকর। কামনা উদ্রেককারী বস্তুতে রূপান্তরকরণ করাই নারীকে অধীনস্ত রাখবার মৌলিক প্রক্রিয়া বলে চিহ্নিত করেছেন ম্যাককিলন। পুরুষতান্ত্রিক ও
শ্রেণীবিভক্ত সমাজে যে ভোগবাদী সংস্কৃতি বিজ্ঞাপন প্রচার করে, তা সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের বাস্তবতাকে এক মায়াময়, ধোঁয়াটে ও অলীক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞাপনের প্রভাব শুধু বর্তমান প্রজন্মই বহন করে না, শিশুদের মধ্যেও এ মতাদর্শ সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে থাকে। ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জেন্ডার
অসংবেদনশীল হয়ে গড়ে উঠার আশংকা থাকে। তাই বাংলাদেশ সরকারকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত, প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের মূল্যায়নের জন্য একটি কমিশন গঠন করতে হবে। এ কমিশনের কাজ হবে যা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সুষ্ঠুভাবে উপস্থাপিত হওয়ার সাংবিধানিক অধিকারকে অক্ষুণ্ণ রাখবে।