বাংলাদেশের পরিবারের সাম্প্রতিক পরিবর্তনের ধারা আলোচনা কর।
অথবা, আমাদের সমাজের সাম্প্রতিক পরিবারের পরিবর্তিত ধারা সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের পরিবারের সাম্প্রতিক পরিবর্তনের ধারা বর্ণনা কর।
উত্তর ভূমিকা : পরিবার গ্রামীণ সমাজের কেন্দ্র। কারণ পরিবারকে ঘিরেই গ্রামীণ সমাজের সকল বিষয় আবর্তিত হয়। কিন্তু কৃষি বিপ্লব, শিল্পবিপ্লব, শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির আবিষ্কারের ফলে বিবাহ ও
পরিবার প্রথায় ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সাম্প্রতিক বাংলাদেশের বিবাহ ও পরিবার প্রথায় এর প্রভাব পড়েছে।বাংলাদেশে পরিবারের সাম্প্রতিক পরিবর্তনশীল ধারা : পুঁজিবাদ ও বিশ্বায়নের প্রভাবে বাংলাদেশের
সমাজব্যবস্থায় বিশেষ করে পরিবার প্রথার ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নিম্নে বাংলাদেশের পরিবার প্রথার পরিবর্তন ধারা
আলোচনা করা হলো :
১. পরিবারের আকারের পরিবর্তন : শিল্পায়ন ও নগরায়ণ যেহেতু কর্মসংস্থানের কিছুটা সুযোগ সৃষ্টি করেছে, সেহেতুয়গ্রামের যৌথ পরিবার থেকে অনেকে নগরে কাজ করতে গিয়ে একক পরিবার গড়ে তুলছে। অনেকে দেশের বাইরে চাকরি
ও ব্যবসায় করতে গিয়ে একক পরিবারে বসবাস করছে। যৌথ পরিবারে তাই ভাঙন দেখা দিয়েছে। এজন্যই পরিবারের আকার এবং কাঠামোয় এসেছে পরিবর্তন।
২. অর্থনৈতিক কাজে পরিবর্তন : বাংলাদেশের গ্রাম সমাজে পরিবারগুলো ভূকেন্দ্রিক বা ভূমি নির্ভর হওয়ায় পরিবারস্থ লোকদের ভৌগোলিক সচলতা হ্রাস পায়। এখানে কৃষিকাজ ছাড়া এখনো অনেক পেশাভিত্তিক পরিবার রয়েছে, যেমন- তাঁতি, জেলে, কুম্ভকার, ক্ষুদে ব্যবসায়ী, কামার, গোসালা ইত্যাদি। এসব লোকদের মধ্যে পেশা পরিবর্তনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। গ্রামের শিক্ষিত যুবকরা কৃষির উপর নির্ভরশীলতা ত্যাগ করে চাকরিবাকরি বা ব্যবসায় বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবিকা অর্জনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ফলে গ্রামীণ পরিবারের অর্থনৈতিক অবকাঠামোয় পরিবর্তন ঘটছে।
৩. সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন : সাধারণত দেখা যায়, গ্রামীণ পরিবারগুলোতে শিশু-কিশোরদের আচারব্যবহার
ও শিক্ষাদীক্ষা পিতা মাতার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানের উপর নির্ভরশীল থাকে। গ্রামের যৌথ পরিবারগুলোতে রক্ষণাবেক্ষণের কাজে দাদা দাদি, নিকট আত্মীয়স্বজন এমনকি প্রতিবেশীরাও সহযোগিতা করেন। যৌথ পরিবারের সন্তানসন্ততিরা
আত্মসংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের শিক্ষালাভ করে।
৪. অবকাশ রঞ্জক কাজে পরিবর্তন : পূর্বে গ্রামীণ পরিবারের সদস্যদের অবসর বিনোদনের একমাত্র ক্ষেত্র ছিল পরিবার। বর্তমান কালে গ্রামীণ সমাজে পরিবারের বাইরে অবকাশ রঞ্জনের বহুমুখী ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। খেলার মাঠ,
হাটবাজার, গল্পগুজব, সিনেমা, রেস্তোরাঁ প্রভৃতিতে আজকাল গ্রামীণ পরিবারের সদস্যরা অবসর সময় কাটায়। যদিও জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসার একদিকে গ্রামের পরিবারগুলোর অবকাশ রঞ্জক কার্য গ্রহণ করেছে, অন্যদিকে আবার রেডিও,
টেলিভিশন প্রভৃতির মতো জিনিস সরবরাহ করে পরিবারের হাতেই এ কার্যকে ফিরিয়ে দিয়েছে।
৫. পরিবারের রাজনৈতিক ভূমিকায় পরিবর্তন : গ্রামীণ সমাজে পরিবার ছাড়াও রাজনৈতিক শিক্ষাদানের জন্য প্রতিষ্ঠানের . অভাব নেই । তথাপি নিয়মশৃঙ্খলা, অধিকার, কর্তব্য ও নেতৃত্বের মূল ধারণা পরিবারেই দেয়া হয়। সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কাজের বিষয়েও একই কথা বলা চলে। বর্তমানে গ্রামীণ পরিবার রাজনৈতিক কার্য, রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য সংগঠন গ্রহণ করেছে।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ফলে পরিবারের রাজনৈতিক শিক্ষায় কিছুটা শিথিলতা এসেছে। উল্লেখ্য যে, গ্রামীণ সমাজের রাজনীতি বা Village politics দিন দিন জটিলতর রূপ নিচ্ছে। ফলে গ্রামীণ পরিবারে এর নেতিবাচক প্রভাব লক্ষণীয়।
৬. সাংস্কৃতিক পরিবর্তন : গ্রামীণ সংস্কৃতি ও চিত্তবিনোদন ব্যবস্থা নগর সংস্কৃতির তুলনায় অধিকতর ঐতিহ্যবাহী, যাতে আবহমান গ্রাম জীবনের স্বরূপ ফুটে উঠে। গ্রামীণ সমাজে শ্রেণি বৈষম্য তুলনামূলকভাবে কম। তাই এখানকার বিভিন্ন ধরনের লোকসংগীত, খেলাধুলা ও যাত্রাভিনয়ে গ্রামীণ সংস্কৃতির একটি অভিন্ন চিত্র দেখা যায়। আধুনিক গণযোগাযোগ মাধ্যমে নগর
সংস্কৃতির প্রভাব গিয়ে পড়ে গ্রামীণ সংস্কৃতির উপর। ফলে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ সংস্কৃতি সর্বদাই পরিবর্তনশীল রূপ পরিগ্রহ করচ্ছে।
৭. ধর্মীয় ঐক্যে পরিবর্তন: গ্রামীণ পরিবারের সদস্যগণ সাধারণত একই রকম ধর্মীয় চেতনার দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত হয়। এছাড়া গ্রাম সমাজের নিরক্ষর লোকের সংখ্যা বেশি থাকায় বিধিবদ্ধ প্রাচীন সামাজিক কুসংস্কারগুলো এখনো
টিকে রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সচেতনতার প্রভাব গ্রামের শিক্ষিত লোকদের মধ্যে কিছু কিছু দেখা যায় ।
৮. বিবাহ ব্যবস্থায় পরিবর্তন: গ্রামীণ পরিবারের বিবাহ প্রতিষ্ঠানেও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। পাত্রপাত্রী নির্বাচনের সময় পিতা মাতা তাদের ছেলেমেয়েদের মতামত গ্রহণ করছেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, পুঁজিবাদ, মুক্তবাজার অর্থনীতি তথা বিশ্বায়নের প্রভাবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোতেও এর প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে এদেশের বিবাহ ব্যবস্থা ও পরিবার প্রথায় পূর্বের তুলনায় ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাব সবচেয়ে বেশি । তাছাড়া বিশ্বে খাদ্য সংকট এবং ধনী গরিব বৈষম্যও বিবাহ ও পরিবার প্রথার পরিবর্তনের জন্য দায়ী।