বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য আর্থসামাজিক অবস্থার কী
ধরনের পরিবর্তন কাম্য বলে তুমি মনে কর?
অথবা, বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন কী আবশ্যকীয়? ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : রাষ্ট্র গঠনের অপরিহার্য উপাদান হলো জনসংখ্যা। জনসংখ্যা ছাড়া যেমন কোনো রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না, তেমনি এটা ছাড়া কোন জাতির অর্থনৈতিক উন্নতির মুক্তি সম্ভব নয়। একটি সুস্থ, দক্ষ,
প্রত্যেকটি দেশের জন্যই মূল্যবান সম্পদ। তবে জনাধিক্য সমস্যা জাতির মঙ্গলের পরিবর্তে অমঙ্গল বয়ে আনে। এ
কর্মঠ জনশক্তি অপরিহার্য উপাদানটি অন্যান্য আরও অনেক সমস্যার জন্ম দেয়। তাই জনসংখ্যার প্রয়োজনীয়তা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি
জনসংখ্যা শান্তি বিঘ্নের কারণও হয়ে দাঁড়ায়।ৎবাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যে কাম্য আর্থসামাজিক পরিবর্তনসমূহ : জনসংখ্যার
সমস্যা নিত্য নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে। তাই জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। এ সমস্যা সমাধানের জন্য
নিম্নোক্ত আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন বলে আমি মনে করি :
১. অর্থনৈতিক উন্নয়ন : জনসংখ্যা সমস্যার স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন।ৎব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলে জনসংখ্যা দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করা সম্ভব হলে এটা আর জাতির জন্য বোঝা হয়ে থাকবে না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে জনসংখ্যার অবস্থান্তর ঘটবে এবং জন্মহার হ্রাসের মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার
কমবে। এ কারণে দ্রুতগতিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা দরকার। এর জন্য দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু
ব্যবহার ও বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের সঞ্চয় এবং বিনিয়োগ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
২. শিক্ষার ব্যাপক প্রসার : শিক্ষার সাথে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে
জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম। শিক্ষার ফলে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে যার ফলে দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি সম্বন্ধেৎসম্যক জ্ঞান লাভ হয় এবং পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাস পায়।
৩. জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন : জীবনযাত্রার মান উন্নত হলে মানুষ জীবনের স্বাদ পরিপূর্ণভাবে গ্রহণে আগ্রহী হয়। এর
ফলে জীবনযাত্রার উচ্চমান বজায় রাখা এবং একে আরও উন্নত স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য মানুষ ছোট পরিবারে আগ্রহী হয়েৎউঠে । সুতরাং, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবনযাত্রার মান উন্নত হলে জনসংখ্যা সমস্যা অনেকাংশে লাঘব হবে।
৪. নারী শিক্ষার অভাব : নারী শিক্ষার অভাবেও দেশের জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। অশিক্ষিত নারীরা অধিক সন্তান লাভে্যউৎসাহী হয়। তাছাড়া, জনসংখ্যা নীতিগুলো পুরাপুরি বাস্তবায়নের জন্য নারী শিক্ষার ভূমিকা অনস্বীকার্য। নারী শিক্ষার প্রসার ঘটলে পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থা গ্রহণের আগ্রহ বেড়ে যাবে ফলে জনসংখ্যা সমস্যা কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
৫. পরিবার পরিকল্পনা : বাংলাদেশের জনসংখ্যার অবস্থান্তর দ্রুত পরিবর্তনের জন্য জনগণের মধ্যে পরিবার
পরিকল্পনার ধারণা সৃষ্টি করতে হবে। প্রত্যেকে যেন তার সামর্থ্য অনুযায়ী পরিবারের আকার ছোট রাখে। এভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
৬. মহিলাদের কর্মসংস্থান : কর্মজীবী মহিলারা সঙ্গত কারণেই কম সন্তান কামনা করে। সুতরাং, তাদের অন্দরমহলে বন্দি না রেখে বাইরের আলো বাতাসের সাথে পরিচিত করতে হবে, তাদের বাইরের কর্মে নিয়োগ দিতে হবে। অতএব, জনসংখ্যা সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান করতে হলে এরূপ আর্থসামাজিক পরিবর্তন দরকার, যাতে মহিলারা ঘরের বাইরে বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত হতে পারে।
৭. নারীর ক্ষমতায়ন : বাংলাদেশে পুরুষশাসিত পরিবার পদ্ধতিতে নারীরা নিজ পরিবারে অবহেলিত। ফলে নারী পরিবারের আকার নির্ধারণে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে না। তাই নারীকে সম্পদের মালিকানা দিয়ে যদি সুখময় অধিকারী করে তোলা যায়, তাহলে পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি সহজে বাস্তবায়িত হবে। নিজ কাজের ব্যবস্থাকরণেও
জনসংখ্যা কমবে।
৮. জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন : বাংলাদেশের সর্বত্র চিকিৎসার সুবিধা প্রসার ঘটিয়ে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও শিশু মৃত্যুর হার রোধ করতে পারলে মানুষ অধিক সন্তানে আগ্রহী হয় না। সুতরাং, জনসংখ্যা সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্যে গণস্বাস্থ্যের উন্নয়ন একান্ত আবশ্যক।৯. সামাজিক নিরাপত্তার অভাব : বৃদ্ধ বয়সে মানুষ সামাজিকভাবে অসহায় হয়ে পড়ে। তারা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তাদের ছেলেসন্তানদের উপর। যথাযথ কারণে আমাদের সমাজে ছেলে সন্তানের প্রতি আগ্রহ বেশি। ছেলে সন্তানের আশায় অনেক সময় জনসংখ্যা বেড়ে যায় । বৃদ্ধ বয়সে সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা থাকলে জনসংখ্যা সমস্যা কিছুটা হলেও লাঘব হবে।
১০. আইন প্রণয়ন : বাল্যবিবাহ এবং বহু বাহের মাধ্যমে জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়। সুতরাং, বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহ রোধকল্পে বাংলাদেশে এতদসংক্রান্ত আইনের কড়াকড়ি প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
১১. চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা : চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা না থাকলে মানুষ অধিক হারে স্ত্রীসজ্ঞ কামনা করে, এতে করে জনসংখ্যা বেড়ে যায়। যদি পর্যাপ্ত চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা থাকে, তাহলে জন্মহারও হ্রাস পেয়ে জনসংখ্যা সমস্যা কমবে। এ কারণে চিত্তবিনোদন ব্যবস্থায় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন হওয়া দরকার।
১২. বাল্যবিবাহ : বাল্যবিবাহের সাথে জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটি প্রত্যক্ষ সংযোগ বিদ্যমান। বাল্য বয়সে যৌন জ্ঞান না থাকার কারণে তারা অপরিকল্পিত সন্তান জন্মদান করে চলে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই বাল্যবিবাহ ব্যবস্থার বিলোপ করতে হবে।
১৩. বেকারত্ব : বেকারত্ব এবং জনসংখ্যা সমস্যা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। জনসংখ্যা সমস্যা যেমন বেকারত্ব বৃদ্ধি করছে, তেমনি বেকারত্ব আবার জনসংখ্যার আকার বৃদ্ধি করে চলেছে। বেকারেরা বেশির ভাগ সময় হতাশায় ভোগে এবং কাজ না থাকায় বেশিরভাগ সময় স্ত্রীসঙ্গ সুখ লাভ করে। হতাশা থেকে মুক্তি পেতে স্ত্রীসঙ্গ লাভ করতে যেয়ে জনসংখ্যা
বেড়ে যাচ্ছে। সুতরাং, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বেকারত্ব কমাতে হবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা হতে এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশের মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা সর্বক্ষেত্রে উন্নত প্রক্রিয়ায়
বাধা প্রদান করছে। বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের সংকুলান করতে গিন সরকারকে হিমসিম খেতে হচ্ছে। সর্বোপরি জীবনযাত্রার মান নিম্নগামী। সুতরাং, বাংলাদেশের এ বিশাল আয়তনের জনসংখ্যাকে সম্পদ না বলে দায় বলাই শ্রেয়।