বাংলাদেশের জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।

বাংলাদেশের জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাংলাদেশে জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী? আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : একটি দেশ গঠনের জন্য যে কয়েকটি উপাদান অপরিহার্য জনসংখ্যা তন্মধ্যে অন্যতম। কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জনসংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে
অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্বিত করতে হলে শ্রমশক্তি অপরিহার্য আর জনসংখ্যাই হলো এর উৎস। প্রত্যেকটি দেশের জনসংখ্যার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যে কোনো দেশের ভৌগোলিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তার জনসংখ্যাকে প্রভাবিত করে। মানব উন্নয়নসূচকের মাধ্যমেও জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্য নিরূপিত হয়।
জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্য : নিম্নে বাংলাদেশের জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা করা হলো :
১. জনসংখ্যার বৃহদায়তন : বাংলাদেশের জনসংখ্যার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বিশালাকার আয়তন। জনসংখ্যার আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম দেশ। মাত্র ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার
আয়তনবিশিষ্ট এ ক্ষুদ্র দেশটির বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা ছিল ১২.৯২ কোটি আর ২০১১ সালে তা ১৪.৬৩ কোটিতে উন্নীত হয়। বাংলাদেশের এ বৃহৎ জনসংখ্যা আজ জনসম্পদের পরিবর্তে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২. জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার : বাংলাদেশের জনসংখ্যা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে এ দেশের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ছিল ২.১২%। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৪%।
লোক গাদাগাদি করে বসবাস করছে। বিশেষ করে ঢাকা শহরসহ বড় বড় শহরে এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এতে করে জনস্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। ২০১১ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষার হিসাবানুযায়ী প্রতি ৩. উচ্চ জনসংখ্যার ঘনতু: বাংলাদেশ একটি অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশের অনেক জায়গায় এখনও
বিশ্বেরই জনসংখ্যার মৃত্যুহার কমে গেছে, তার ঢেউ বাংলাদেশেও লেগেছে। এ মৃত্যু হারের নিম্নগতি এবং জন্মহারের
8, উচ্চ জন্মহার : উচ্চ জন্মহার বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রধান বৈশিষ্ট্য। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আশির্বাদে সারা বর্গকিলোমিটারে ৯৯৩ জন লোক বসবাস করছে যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অত্যন্ত বেশি।
ঊর্ধ্বগতির কারণে এদের ব্যবধান বেড়ে একটি উচ্চহারে বেড়ে চলেছে। তবে কারণে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে জন্মহার কমতে শুরু করেছে।
ইদানিং পরিবার পরিকল্পনার জনপ্রিয়তার
আয়ুষ্কাল অনেক কম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের গড় প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল ৭৩ বছর এবং ব্রিটেনের জনগণের প্রত্যাশিত গড়
তনুধ্যে পুরুষের গড় আয়ুষ্কাল ৬৬.৮ এবং মহিলাদের ৭০ বছর। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের এ প্রত্যাশিত
৫. আয়ুষ্কাল : “বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১১ এ প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের গড় আয়ুষ্কাল ৬৮.৬ বছর।
আয়ুষ্কাল ৭২ বছর। তবে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী আমাদের প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল পূর্বের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে।
৬. নারী পুরুষ অনুপাত : বাংলাদেশে স্ত্রীলোক অপেক্ষা পুরুষের সংখ্যা বেশি। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের স্ত্রীলোক ও পুরুষের অনুপাত ১০০ : ১০৫.০। বাংলাদেশে এখনও গর্ভাবস্থায় নারী মৃত্যুর হার বেশি বিধায় নারীর সংখ্যা কম। তবে চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্নতির কারণে ক্রমে নারীর সংখ্যা বাড়ছে। তাই ১৯৬১ এবং ২০০১ সালে নারী
যথাক্রমে ১০০ : ৯৯.৭ এবং ১০০ : ৯৬.২। অর্থাৎ, এখানে নারীর সংখ্যাই বেশি। নিম্নের সারণিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন পুরুষ অনুপাত ছিল যথাক্রমে ১০০ : ১০৭.৬ ও ১০০ : ১০৩.৮। পক্ষান্তরে, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানে এর অনুপাত হচ্ছে সালের আদমশুমারি অনুযায়ী স্ত্রী এবং পুরুষের অনুপাত প্রদান করা হলো :
৭. নিম্ন শিক্ষিতের হার : বাংলাদেশে শিক্ষিতের হার খুবই কম। এদেশের শতকরা মাত্র ৬৪ ভাগ শিক্ষিত। আমাদের নারী শিক্ষার হার আরও কম।
৮. বেশিরভাগ লোক গ্রামে বাস করে : কোনো দেশের জনসংখ্যার গ্রাম ও শহরভিত্তিক বণ্টনের চিত্র থেকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি প্রকৃতি সম্বন্ধে ধারণা নেওয়া যায়। সাধারণত উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ শহরে বাস করে। যেখানে ইংল্যান্ড ৭৬%, আমেরিকায় ৭৪%, ফ্রান্সে ৭৮% এবং জাপানে ৭৬% লোক শহরে বাস করে, সেখানে বাংলাদেশে ২০% লোক শহরে বাস করে অর্থাৎ, ৮০% লোকই গ্রামে বাস করে।
৯. নির্ভরশীল জনসংখ্যার আধিক্য : ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ১৫-৫৯ বছর বয়সের মোট জনসংখ্যার
৪৯.৫%, বাকি ১৫ বছরের কম বয়স্ক শিশুর পরিমাণ মোট জনসংখ্যার ৪৫.১% এবং ৬০ বছর বয়স্ক মানুষের পরিমাণ
৫.৪%। অর্থাৎ, ৫০.৫% মানুষ নির্ভরশীল এবং ৪৫:৫% মানুষ উপার্জনে সক্ষম। যেখানে অন্যান্য দেশের নির্ভরশীলতার
হার অত্যন্ত কম। ১০ নিম্ন মানব উন্নয়ন : বাংলাদেশের জনসংখ্যা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কারমুক্ত মানসিকতা ও সার্বিক দক্ষতার বিবেচনায়
অনগ্রসর। মানব উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের স্বাধীনতাকে বৃদ্ধি করা যায়। UNDP এর Human Development Report ২০১১ এ অন্তর্ভুক্ত ১৭৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৩ তম। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ নিম্ন মানবসম্পদ উন্নয়নভুক্ত দেশের অন্তর্গত। তবে অতি সম্প্রতি রিপোর্টে বাংলাদেশ নিম্ন হতে মধ্যম মানবসম্পদ উন্নয়ন গোত্রভুক্ত হয়েছে।
১১. দুর্বল জনস্বাস্থ্য : বাংলাদেশের জনসংখ্যার গড় স্বাস্থ্য প্রত্যাশিত নয়। দেশের শ্রমশক্তি সরবরাহ করে জনসংখ্যা যে কারণে সুস্থ, স্বাস্থ্যবান জনশক্তি একান্তই কাম্য। বাংলাদেশে মাথাপিছু চিকিৎসা খরচ ধরা হয়েছে বাৎসরিক ২২৫ টাকা। এ সামান্য টাকা ব্যয় বরাদ্দ দিয়ে একটি স্বাস্থ্যবান জাতি কল্পনা করা যায় না। তাছাড়া, এ খাতের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে
বরাদ্দকৃত সামান্য ব্যয় সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগানো যায় না।
১২. সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা মুসলিম : বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের জনগোষ্ঠী বাস করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যাই মুসলমান। জনসংখ্যা সমস্যা উন্নয়নশীল দেশসমূহের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ আর্থসামাজিক সমস্যা। এ সমস্যার কারণে অন্যান্য সমস্যাগুলো দূর করা সম্ভব হয় না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ঋণাত্মক বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। অধিক জন্মহার, বাল্যবিবাহ, দারিদ্র্য প্রভৃতি কারণে দেশের জনসংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে যা আরও অন্যান্য আর্থসামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। আমাদের সার্বিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন
ত্বরান্বিত করার জন্য জনসংখ্যা সমস্যা দূর করতে হবে।