অথবা, বাংলাদেশের জনগণের বিভিন্ন প্রকার চাহিদা পূরণের প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের জনগণের বিভিন্ন প্রকার চাহিদা পূরণের পথে বাধাগুলো বর্ণনা কর।
অথবা, তোমার মতে আমাদের দেশে জনগণের চাহিদা পূরণের পথে কী কী প্রতিবন্ধকতা আছে?
অথবা, জনগণের চাহিদা পূরণের অন্তরায়সমূহ লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানুষকে তার জীবনধারণের জন্য কতকগুলো উপাদানের প্রয়োজন পড়ে। এসব উপাদান কেন্দ্রিক ব্যক্তির এই যে প্রয়োজন এটাই হল ব্যক্তির চাহিদা। ব্যক্তি যদি তার এ চাহিদা স্বাভাবিকভাবে সঠিকপথে পূরণ করতে সক্ষম না হয় তবে সে বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয় বা তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে। তবে ব্যক্তির চাহিদা পূরণের পশ্চাতে সমাজে বা রাষ্ট্রে ঐসব উপকরণের পর্যাপ্ততা থাকতে হবে। বাংলাদেশে তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ যার মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। অথচ মোট আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিঃমিঃ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যা বাস করে প্রায় ৮৩৯ জন। এদেশের জনসাধারণের মৌল মানবিক চাহিদা অপূরণসহ অন্যান্য বহুবিধ সমস্যা বিদ্যমান।
বাংলাদেশের জনগণের বিভিন্ন প্রকার চাহিদা পূরণের পথে অন্তরায় বা প্রতিবন্ধকতাসমূহ :
বাংলাদেশের জনগণের বিভিন্ন প্রকার চাহিদাসমূহ পূরণের পথে যেসব অন্তরায় বা প্রতিবন্ধকতাসমূহ লক্ষ্য করা যায় তা নিম্নে আলোচনা করা হল:
১. জনসংখ্যাস্ফীতি : বাংলাদেশের জনসাধারণের মৌল চাহিদাসহ অন্যান্য চাহিদা পূরণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা বা অন্তরায় হল অধিক জনসংখ্যা। ২০০১ সালের লোকগণনা অনুযায়ী দেশের সর্বমোট জনসংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি
জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতিবর্গ কিলোমিটারের ৮৩৯ জন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রায় ১.৪৭ এবং ২০০৪ সালে এ জনসংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ১৩ কোটি ৫২ লক্ষ, জনসংখ্যার ঘনত্ব ৯১৬ জন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৫ জন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই যে trend এবং বর্তমান অবস্থা দেশটির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। দেশের মোট উৎপাদন ও সম্পদের তুলনায় বিদ্যমান জনসংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে জনসাধারণের সকল চাহিদা সমানভাবে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
২. দারিদ্র্য : এদেশের জনগণের চাহিদা পূরণের পথে আর একটি বড় বাধা হল দারিদ্র্য। ২০০৪ সালের তথ্যানুযায়ী এদেশে জনপ্রতি মাথাপিছু বার্ষিক আয় ৪৪৪ মার্কিন ডলার এবং মাথাপিছু GDP ৪২১ ডলার। এখানে গ্রামের শতকরা ৩৭.৪০ ভাগ এবং শহরের ১৯.১০ ভাগ জনগোষ্ঠী নি দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে।ফলে দেখা যায় এদেশের জনগণের নিমানের আয় স্বল্প পরিমাণে ক্রয় ক্ষমতা এবং স্বল্প ভোগ এরকম একটি দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে।
৩. নিরক্ষরতা : আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪৭.৫% শিক্ষিত (লোক গণনা, ২০০১)। সুতরাং দেখা যাচ্ছে দেশের মোট জনসংখ্যার একটা বড় অংশই নিরক্ষর। এরা নিজেদের চাহিদা ও প্রয়োজন সম্পর্কে খুব একটা সচেতন নয়। তারা নিজেদের স্বাস্থ্য রক্ষা ও উন্নয়নের জন্য করণীয় সম্পর্কেও অজ্ঞ। ফলে তারা যেমন নিজের জন্য তেমনি দেশের জন্যও বোঝা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। নিজেদেরকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং দেশে বিদ্যমান সম্পদের উপর বড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।
৮. বেকারত্ব : বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ১০ বছর বয়সের উপরে বয়সীদের মধ্যে ২৮.৪ ভাগ কোন কাজ করে না (লোক গননা-২০০১)। আর এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে দেশে মোট বেসামরিক শ্রম শক্তির পরিমাণ ৬.০৩ কোটি (১৯৯৯-২০০০ সালের শ্রম শক্তি জরিপ)। সুতরাং দেখা যায়, এ দেশের প্রায় ১৫ কোটি জনসাধারণের মাত্র ৬-৭ কোটি শুধুমাত্র কর্মজীবী এবং বাকি অংশ এদের উপর নির্ভরশীল। অথচ যদি এদের জন্য যথাযোগ্য কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা
বিধান করা যেত তবে মৌল চাহিদাসহ অন্যান্য চাহিদা পূরণ সহজ হতো।
৪. রাজনৈতিক অস্থিরতা : আমাদের দেশের জনসাধারণের চাহিদাসমূহ পূরণের পথে অন্যতম বড় বাধা হল রাজনৈতিক অস্থিরতা। যে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যতবেশি সে দেশের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের মাত্রাও তত সন্তোষজনক। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মূলকথা হল কর্মসূচির স্থীতিশীলতা, কিন্তু আমাদের দেশের সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে পূর্ববর্তী সরকার প্রণীত যাবতীয় কর্মসূচি পরিবর্তন করে ফেলা হয়। যা জনসাধারণের চাহিদা পূরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
৫. জীবনযাত্রার দ্রুত ব্যয় বৃদ্ধি : বাংলাদেশে জনসাধারণের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিজনতি সমস্যা একটি নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে।দেশে ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পথে জনসাধারণ তালমিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ দ্রব্যমূল্য যে হারে বাড়ছে সে হারে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় নি। ফলে তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীজনিত ভোগের পরিমাণ বাধ্য হয়েই কমাতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের জনসাধারণের বিভিন্ন চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে আলোচ্য প্রতীবন্ধকতাগুলো বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এছাড়া রয়েছে কুসংস্কার, নারী শিক্ষার অভাব, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি ইত্যাদি।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, বাংলাদেশে জনগণের বিভিন্ন ধরনের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে যে অন্তরায় বা প্রতিবন্ধকতাগুলো বিদ্যমান তা একদিনে সৃষ্টি হয় নি। বস্তুত নিজেদের চাহিদা ও প্রয়োজন সম্পর্কে অসচেতনতা, ব্যাপক মাত্রার নিরক্ষরতা বা অজ্ঞতা এবং ধারাবাহিকভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে আস্তে আস্তে চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে কতকগুলো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে।