উত্তরঃ ভূমিকা : বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৬০ জনই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এদেশের কৃষি ব্যবস্থা কিংবা কৃষক কারো অবস্থাই ভালো নয়। কৃষি কাজ পরিচালনার জন্য যে প্রচুর পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয় সে পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের কৃষকদের নেই। এছাড়া এ দেশের অধিকাংশ কৃষকই ভূমিহীন বা প্রান্তিক কৃষক। এদেশের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা কার্যকরী না হওয়ায় কৃষকের অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটছে না। তাছাড়া কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীরও ন্যায্যমূল্য পায় না। এজন্য এদেশের কৃষক সমাজ আজ ঋণে জর্জরিত।
কৃষিঋণের উৎসসমূহ: বাংলাদেশের কৃষিঋণের উৎসসমূহকে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
ক. অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎসসমূহ ও
খ. প্রাতিষ্ঠানিক উৎসসমূহ।
নিম্নে কৃষি ঋণের অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস আলোচনা করা হলো:
ক. অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎসসমূহ: কৃষিঋণের অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎসসমূহ নিম্নরূপ:
১. আীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব: বাংলাদেশের কৃষিঋণের অন্যতম প্রধান উৎস হলো আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু- বান্ধব। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধবান্ধবের নিকট হতে ঋণ গ্রহণের সুবিধা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঋণের জন্য সুদ প্রদান করতে হয় না আর হলেও তার পরিমাণ খুবই কম থাকে।
২. গ্রাম্য মহাজন: বাংলাদেশের কৃষিঋণ ব্যবস্থায় গ্রাম্য মহাজনেরা এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তারা কৃষকদের কাছ থেকে অলঙ্কার, জমি ও অন্যান্য স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে উচ্চ সুদের হারে ঋণ প্রদান করে থাকে।
৩. গ্রাম্য ব্যবসায়ী ও দোকানদার: বর্তমানে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ও দোকানদার দেখা যায় যারা গ্রাম্য মহাজনের শূন্যস্থান পূরণের চেষ্টা করছে। এসব ব্যবসায়ী ও দোকানদারগণ কৃষকের উৎপাদিত ফসল অল্প দামে ক্রয় করার উদ্দেশ্যে তাদেরকে অগ্রিম টাকা প্রদান করে।
৪. গ্রাম্য বিত্তশালী কৃষক: গ্রামের অনেক বিত্তশালী ও ধনীকৃষকেরা মধ্যবিত্ত কৃষক এবং ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষিদেরকে অতি উচ্চ সুদে ঋণ প্রদান করে থাকে। ঋণ প্রদানের সময় তারা নানা ধরনের শঠতা ও প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে। এর কারণে ঋণগ্রহীতা কৃষকেরা ক্রমশ ভূমিহীন ও নিঃস্ব কৃষককুলে পরিণত হয়। ৫.
৫. ফড়িয়া ও বেপারি: আমাদের কৃষি পণ্যের বাজারে ফড়িয়া, বেপারি প্রভৃতি এক শ্রেণির মধ্যবর্তী কৃষক থাকে। তারা চড়া সুদে কৃষকদের ঋণ দিয়ে থাকে। আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, নানা প্রয়োজনে বাংলাদেশের কৃষকরা বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস হতে ঋণ সংগ্রহ করে। এর কারণে তাদেরকে চড়া সুদ প্রদান করতে হয়।
খ. প্রাতিষ্ঠানিক উৎসসমূহ: কৃষিঋণের প্রাতিষ্ঠানিক উৎসসমূহ নিম্নরূপ:
১. বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে: কৃষি ঋণের বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক উৎসের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ভূমিকা সর্বাপেক্ষা, গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাংক কৃষকদের সার, বীজ, কীট নাশক যন্ত্রপাতি প্রভৃতি ক্রয়ের জন্য স্বল্পমেয়াদি ঋণ, কৃষি যন্ত্রপাতি, হালের বলদ প্রভৃতি ক্রয়ের জন্য মধ্যমেয়াদি ঋণ এবং ট্রাক্টর ও অন্যান্য ভারী যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করে। ঋণ প্রদানে এ ব্যাংকের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২. ভূমি বন্ধকি ব্যাংক: বাংলাদেশের কৃষক নিজেদের জমি বন্ধক রেখে ভূমি বন্ধকি ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারে। এ ঋণ বেশ দীর্ঘমেয়াদি। সাধারণত ২০ বছর মেয়াদের জন্য এ ঋণ প্রদান করা হয়। ভূমি বন্ধকি ব্যাংকের সংখ্যা বাংলাদেশে খুব কম। কাজেই এ ব্যাংক কৃষকদের ঋণের চাহিদা সামান্যই মিটাতে পারে।
৩. বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক: কৃষিঋণের বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক উৎসের মধ্যে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। বিভিন্ন সমবায় প্রতিষ্ঠান; যেমন- জাতীয় সমবায় ব্যাংক, সমবায় ঋণদান সমিতি প্রভৃতি কৃষিঋণ সরবরাহ করে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সমবায় ব্যাংকের স্বাভাবিক কৃষিঋণ কর্মসূচিতে অর্থের যোগান দেয়।
৪. বাংলাদেশ ব্যাংক: বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি কৃষকদেরকে ঋণ বিতরণ করে না। কৃষি ব্যাংক, ‘বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লিমিটেড ও অন্যান্য ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে কৃষকদেরকে ঋণ প্রদান করে থাকে।
৫. রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক: অতীতে তেমন একটা অবদান না রাখলেও বর্তমানে বেশ কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক কৃষকদের ঋণ প্রদানের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ফেব্রুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিত বিতরণ কৃষকদের মাঝে ৩২,৯০৩.২০ কোটি টাকা।
৬. গ্রামীণ বাংক: বাংলাদেশে কৃষিঋণ সরবরাহের ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংক একটি নতুন সংযোজন। গ্রামীণ ব্যাংক হলো পল্লির ভূমিহীন পুরুষ ও মহিলাদের ঋণদানের জন্য একটি বিশেষ অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান। গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষ তদারকি ও পদ্ধতির মাধ্যনে ঋণের ব্যবহার ও আদায় নিশ্চিত করে। ফেব্রুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত এ ব্যাংক কৃষকদের মাঝে ১,৬৯,৪৭.১২ কোটি টাকা কৃষি ঋণ বিতরণ করেছে।
৭. বাংলাদেশ পরিউইন বোর্ড: বর্তমানে বাংলাদেশে কৃষিঋণ সরবরাহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক উৎস হলো বাংলাদেশ পরিউন্নয়ন বোর্ড। পল্লিউন্নয়ন বোর্ডের প্রধান কাজ হলো গ্রামের গরিব লোকদের জন্য সমবায় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা ও তাদের আয় বৃদ্ধির পথ সুগম করা। ফেব্রুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত বি. আর. ডি. বি মোট ১৪,৮৪৯.৩৪ কোটি টাকা কৃষি ঋণ বিতরণ করে।
৮. সরকার: সরকার বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বীজ, সার, হালের ফলন, কৃষি যন্ত্রপাতি প্রভৃতি জয়ের জন্য কৃষকদেরকে সরাসরি বাণ প্রদান করে থাকে। এ ঋণের সুদের হার খুব কম এবং পরিশোধ করার শর্তও খুব সহজ।
উপসংহারঃ উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের কৃষিঋণের বিভিন্ন জন প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। এরপর বা পাওয়া যায় তা আবার বিভিন্ন জটিলতার কারণে সময়মতো পাওয়া যায় না। এ সমস্যাবলির কারণে কৃষিঋণ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ঋণ ছাড়া কৃষি কাজ সম্পাদন অসম্ভব। তাই কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য আশু সমাধান দরকার।