অথবা, বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় আমলাদের অবদান বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় আমলাতন্ত্রের কার্যাবলি আলোচনা কর
অথবা, বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় আমলাতন্ত্রের ভূমিকা আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের উন্নয়নে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : আধুনিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে আমলাতন্ত্র থেকে পৃথক করা যায় না। অর্থাৎ আধুনিক রাষ্ট্রের সকল কার্য আমলাতন্ত্রের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়। প্রখ্যাত জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার আমলাতন্ত্র ধারণার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান করেন। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের উন্নয়ন
প্রক্রিয়ায় আমলাতন্ত্রের ভূমিকা আলোচনা প্রসঙ্গে আমলাতন্ত্র সম্পর্কে আলোচনা প্রয়োজন। বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় আমলাতন্ত্রের ভূমিকা: বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এক দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে। উন্নয়ন বলতে সাধারণভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বুঝানো হয়। তবে উন্নয়ন সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশে প্রশাসন ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য বৃদ্ধির ফলে আমলাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যও বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং উন্নয়নশীল দেশের সরকারের কার্যাবলির প্রতিটি ক্ষেত্রে আমলাদের উপর নির্ভরশীল Finer, “The functions of the civil service is not merely an improvement of the government, indeed, without it, government itself would be impossible.” কোনো রাষ্ট্র আমলাতন্ত্র ব্যতীত পরিচালনা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় আমলাতন্ত্র বিভিন্ন ভূমিকা
রাখে। নিম্নে এগুলো আলোচনা করা হলো :
১. সরকারি নীতিনির্ধারণ : সরকার কর্তৃক নির্ধারিত নীতি ও আইন বিভাগীয় সিদ্ধান্তসমূহকে বাস্তবে কার্যকরী করা হলো আমলাদের প্রধান কাজ। সরকারি নীতি, আইনকানুন ইত্যাদি কত দূর পর্যন্ত কার্যকরী করা হবে, তা নির্ভর করে আমলাদের দক্ষতা, দৃঢ়তা ও ঐকান্তিক ইচ্ছার উপর। এর অভাব ঘটলে সরকারের উদ্দেশ্য ও নীতিসমূহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে এগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা হয়, যা বাংলাদেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।
২. আইন প্রণয়ন : বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশের আইন প্রণয়নে আমলাতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আইন প্রণয়ন করা হলো আইন বিভাগের কাজ। সরকারি কর্মচারীগণ আইন প্রণয়ন করতে না পারলেও আইন প্রণয়ন ও নীতিনির্ধারণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। রাষ্ট্রের কার্যাবলি বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধির ফলে আধুনিক সরকারকে বহুবিধ জটিল বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে হয়। কিন্তু আইন প্রণয়নে যে দূরদর্শিতা, দক্ষতা ও প্রশাসনিক কলাকৌশলগত জ্ঞানের প্রয়োজন হয় তার জন্য রাজনৈতিক আমলাদের উপর নির্ভর করতে হয়।
৩. সামাজিক পরিবর্তন : একটি গণতান্ত্রিক সরকার কতটুকু দক্ষতার সাথে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল সামাজিক দাবি পূরণ করতে সক্ষম তার উপর নির্ভর করে সে সমাজের সার্থকতা। এ কাজে আমলাতন্ত্রই প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যোগান দিয়ে থাকে । শৈল্পিক যুগের জটিল সমস্যার জন্য প্রয়োজন হয়ে উঠেছে পেশাগত সুদক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মচারীর। তাছাড়া নাগরিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমলারা বিভিন্ন পন্থার উদ্ভাবন ঘটায়। আমলাতন্ত্র একটি সামাজিক যন্ত্রে পরিণত হয় এবং আইনসভার উদ্দেশ্য ও নীতি প্রণয়ন কার্যকে বাস্তবায়ন করে। এভাবে আমলাতন্ত্র আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করে।
৪. বিচার সংক্রান্ত কাজ : Almond and Powell বলেছেন, “সামাজিক ন্যায়বিচার ও বিচার বিভাগীয়
আদালতের সম্প্রসারণের ফলে আমলাদের কিছু বিচার সংক্রান্ত কাজও সম্পাদন করতে হয়।” বর্তমানে অধিকাংশ রাষ্ট্রে অনেক বিবাদ- বিসম্বাদের বিচার আদালতে হয় না। এসব বিচারকার্য প্রশাসনিক সংস্থাসমূহের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। যেমন- বাংলাদেশে শিল্প সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ‘Industrial tribunal’ রয়েছে।
৫. দৈনন্দিন কার্যাবলি পরিচালনা : সরকারের দৈনন্দিন কার্যাবলি পরিচালনা করে আমলাতন্ত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ মিকা পালন করে। সরকারের দৈনন্দিন কাজের মাধ্যমে শিক্ষা, জনহিতকর কার্যাবলি, সামাজিক নিরাপত্তা, পুলিশ ও বচারব্যবস্থা, সেনাবাহিনী, কর ব্যবস্থা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এভাবে বিভিন্ন কার্যাবলির মাধ্যমে আমলাতন্ত্র বাংলাদেশের।উন্নয়নে ভূমিকা পালন করে।
৬. সংস্কারের বাহক : আমলাদের অনেক সময় সংস্কারের প্রবর্তক বা উন্নয়নের নেতা বলে অভিহিত করা হয়। অফিস পরিচালনা সংক্রান্ত উন্নত কর্মপদ্ধতি, সাংগঠনিক কাঠামো আধুনিকীকরণের জন্য এরাই উদ্যোগ গ্রহণ করে। নানা ধরনের সংস্কার কমিটি বা স্থায়ী সংস্থার মাধ্যমে প্রশাসনিক যন্ত্রকে সময়োপযোগী করে তোলে। প্রশাসন যে একটি গতিশীল বিষয় তা বাস্তবে রূপদানে আমলারাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
৭. সংবাদ ও তথ্য সরবরাহ : সংবাদ ও তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাংবাদিকগণ, বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল ও জনগণকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারি নীতি ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহের সংবাদ ও তথ্যাদির জন্য আমলাতন্ত্রের উপর নির্ভর করতে হয়। তাছাড়া সরকারের আইন ও শাসন বিভাগ আমলাতন্ত্র
প্রদত্ত তথ্যাদির উপর ভিত্তি করে আইন প্রণয়ন ও নীতিনির্ধারণ করে থাকে।
৮. রাজনৈতিক প্রশাসকদের পরামর্শ প্রদান : নীতিনির্ধারণ ও আইন প্রণয়নের সময় রাজনৈতিক প্রশাসকগণ অভিজ্ঞ ও কৌশলগত আমলাদের সাহায্য ও পরামর্শ গ্রহণ করেন। তাছাড়া বিভাগীয় সংশিষ্ট সচিব ও মন্ত্রিবৃন্দে মতের সমন্বয়ের ফলে বিভাগীয় নীতিনির্ধারণ করা হয়। কোনো ধরনের নীতি দেশের জন্য কল্যাণকর সে বিষয়ে আমলারা পরামর্শ প্রদান করেন। এভাবে আমলাতন্ত্র বাংলাদেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।
৯. শাসনকার্যে নিরবচ্ছিন্নতা : সুশাসনের জন্য শাসনকার্যে নিরবচ্ছিন্নতা রক্ষা করা প্রয়োজন। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের রাজনৈতিক প্রশাসকগণ কখনও নিরবচ্ছিন্নভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারেন না। রাজনৈতিক পালাবদলের ফলে একেক সময়ে একেক দল ক্ষমতা গ্রহণ করে। আমলাদের কখনও পরিবর্তন ঘটে না, তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করে। এভাবে আমলাতন্ত্র বাংলাদেশের উন্নয়নে ভূমিকা পালন করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের উন্নয়নে বিভিন্ন ভূমিকা পালনে আমলাতন্ত্র সর্বদা ব্রতী। আমলাতন্ত্রের সঠিক দিকনির্দেশনা ছাড়া প্রকৃত অর্থে একটি দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। Joseps La Palambara, “Bureaucracy is an important independent variable that greatly influences any kind of transformation in the developing countries.”