বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র নিরপেক্ষ হওয়ার কারণ কী?

অথবা, বাংলাদেশে কিভাবে আমলাতান্ত্রিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যায়? আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের নিরপেক্ষতার কী কী কারণ রয়েছে?
উত্তর৷ ভূমিকা :
প্রখ্যাত জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার (১৮৬৪-১৯২০) আমলাতন্ত্র সম্পর্কিত কতিপয় যৌক্তিক নীতিমালা প্রণয়ন করেন। পৃথিবীর সর্বত্র আধুনিক কার্যকরী ব্যবস্থাপনা এসব নীতিমালার ভিত্তিতে রাষ্ট্র যন্ত্র পরিচালিত হয়ে থাকে। অবশ্য সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মানুষের সাংস্কৃতিক বিকাশ ও যান্ত্রিক কলাকৌশল আবিষ্কারের সাথে সাথে এর গুণগত পরিবর্তন হয়েছে, তথাপি ওয়েবারের মৌলিক সূত্রগুলোর বিমূর্তরূপ খুব কমই পরিবর্তিত হয়েছে। আর এ আলোচনায় বাংলাদেশের মতো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের বিকাশ এবং আমলাতান্ত্রিক নিরপেক্ষতার প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র নিরপেক্ষ না হওয়ার কারণ : উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত আমলাতন্ত্রের ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতার পৃষ্ঠপোষকতা, রাষ্ট্রীয় সম্পদের সীমাহীন লুটপাট। সর্বোপরি নিজেদেরকে জাপানি সম্রাটদের মতো আইনের ঊর্ধ্বে ভাবার প্রবণতা এসব আমলাদের করেছে গণবিচ্ছিন্ন ও গণতন্ত্র বিরোধী। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমলাতন্ত্রের আধিপত্য রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দারুণ সংকটের সৃষ্টি করেছে। যার ফলে দেশে ক্রমান্বয়ে খুব কমই অর্থনীতির উন্মেষ ঘটছে। বস্তুত আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বৈপরীত্যমূলক অবস্থান, দলীয় আস্তঃকলহ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহিষ্ণুতার অভাব সর্বোপরি দলগুলোর নড়বড়ে অবস্থান বারে বারে সামরিকতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে করে তোলে বিশৃঙ্খলা ও ঘোলাটে। যার ফলে গণতন্ত্র কখনো এখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে নি। রাজনৈতিক দলগুলোর এ পরাজয় আমলাতন্ত্র হয়ে পড়ে শক্তিশালী (Frunk J. Goodnow; Public Administration), যার পরিণতি হিসেবে
এখানে আমলাতন্ত্রই শাসন করছে রাজনৈতিক দলগুলোকে, বিড়াল যেভাবে শাসন করে ইঁদুরকে। অর্থাৎ বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রে নিরপেক্ষতা বজায় থাকছে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমলাতন্ত্রের ইতিহাস কেবল জনগণকে ভক্ষণ করার মধ্যে নিহিত, যা তাদেরকে এখানে অমিত শক্তির অধিকারী করেছে।
বাংলাদেশে আমলাতান্ত্রিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণের উপায় : উপর্যুক্ত অবস্থায় বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রকে নিরপেক্ষ করতে হলে যা করণীয়, তা হলো নিম্নরূপ : প্রথমত, অযোগ্য ও অনভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ এবং জনগণ বিচ্ছিন্ন আমলাদের হাত থেকে বাংলাদেশের প্রশাসনকে রক্ষা করা এবং আমলাতন্ত্রের উপর পূর্ণ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে জোরদার করা, তাদের মধ্যে সহিষ্ণুতা ও সমঝোতার প্রসার ঘটানো। তৃতীয়ত, গণতন্ত্রকে একটি যৌক্তিক গতিময়তা প্রদান তথা গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো নির্মাণ, যেখানে জনগণ হবে সত্যিকার অর্থে সকল ক্ষমতার উৎস। চতুর্থত, রাজনৈতিক ও প্রশাসন হবে গ্রাহক কেন্দ্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কেন্দ্রিক, ব্যক্তি কেন্দ্রিক বা আমলাতান্ত্রিক নয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে বাংলাদেশের একদিকে আমলা প্রাধান্যজনিত সমস্যাটি থেকে যাবে এবং অন্যদিকে গণতন্ত্রের এ বিশাল আয়োজনও ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল ও গণতন্ত্রমনা তৃতীয় বিশ্বের দেশ, যেখানে উত্তরাধিকারসূত্রে আমলাতন্ত্র গড়ে উঠেছে এবং যেখানে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডল মোটামুটি অস্থিতিশীল ও দুষ্টচক্রের আবর্তে চলছে, সেখানে আমলাতন্ত্রকে নিরপেক্ষ ও গণমুখী করতে হলে শুধু আমলাতন্ত্রের কাঠামোতে স ংস্কারই যথেষ্ট নয়, বরং সমস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থাটিতে পরিবর্তন আনয়ন করতে হবে। বস্তুত আমলাতন্ত্রের নিরপেক্ষতা, দক্ষতা ও সাফল্য নির্ভর করে এর পরিচালক বা মন্ত্রণাদাতা অর্থাৎ জনপ্রতিনিধি ও টপ ব্যুরোক্যাটদের সুপরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা যথাযথ বাস্তবায়নের উপর।