বাংলাদেশের আবির্ভাবের কারণসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ আবির্ভাবের ক্ষেত্রে কী কী কারণ দায়ী ছিল?
অথবা, বাংলাদেশের আবির্ভাবের কারণসমূহ সবিস্তারে তুলে ধর।
অথবা, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ আবির্ভাবের ক্ষেত্রে কোনো কোনো কারণ দায়ী ছিল তা খুঁজে বের কর এবং লিখ। উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি স্বাধীন ও
সার্বভৌম রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান এ দুই অংশে বিভক্ত ছিল। পাকিস্তানি শাসকবর্গ শুরু
থেকেই তাদের নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রচলনের প্রতিটি প্রচেষ্টা বানচাল করে দেয় এবং
পূর্ব বাংলাকে শোষণ ও অত্যাচারের লীলাভূমিতে পরিণত করে। তারা পূর্ব বাংলাকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পঙ্গু করে দেয়ার হীন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে পূর্ব বাংলাকে এক উপনিবেশে পরিণত করে। আর এ আন্দোলন সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নেয় ১৯৭১ সালে এবং দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটে। বাংলাদেশের আবির্ভাবের কারণ : বৈষম্য, শোষণ এবং বঞ্চনার শাসন থেকে ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে পূর্ব বাংলার জনগণ বিভিন্ন সময়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তাছাড়া, পশ্চিম পাকিস্তানিরা নানাভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে অত্যাচার ও শোষণ করার দরুনই বাংলাদেশের আবির্ভাব জরুরি হয়ে পড়ে। নিম্নে বাংলাদেশের আবির্ভাবের কারণসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. রাজনৈতিক কারণ : ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পূর্ব বাংলার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পরিস্ফুটিত হয়নি। ১৯৬৬ এর ছয়দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পরেও তারা মেনে নেয়নি। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিষিয়ে উঠে এবং ১৯৭১
সালের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে।
২. অর্থনৈতিক কারণ : পশ্চিমা শাসন ও শোষণের ফলে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হয়। এক হিসাব অনুযায়ী ১৯৪৮-৬৯ সালের মধ্যে মোট ৪১৯ কোটি টাকার সম্পদ পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করা হয়। আবার ১৯৫০-৬৯ সালের মধ্যে পাকিস্তান যে ৫৬৮৩ ডলার সাহায্য লাভ করে তার মধ্যে ৩৪% পূর্ব
পাকিস্তানকে দেয়া হয়। এসব কারণে জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
৩. সামাজিক কারণ : ফলে একই দেশের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও দুই দেশের জনগণের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, আহার-বিহার, জীবনযাত্রা, পেশা, শিল্প, আচার, ব্যবহার এককথায় সামাজিক জীবনের সামগ্রিক ক্ষেত্রে নিজস্ব আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। ফলে রাষ্ট্রীয় জীবনকে সুসংহত করার জন্য কোন একক সামাজিক আদর্শ পাকিস্তানে গড়ে উঠতে পারেন । এটা বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের একটি অন্যতম কারণ ছিল ।
৪. সাংস্কৃতিক সংঘাত : পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী ছিল বাঙালি এবং বাংলা ছিল তাদের মাতৃভাষা কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা সংখ্যালঘিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তারা জোরপূর্বক বাঙালিদের উপর উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। এ দেশের ছাত্র জনতা মায়ের ভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে
রাজপথে নেমে পড়ল। সরকার মিছিলের উপর গুলি চালালে সালাম, বরকত, রফিকসহ আরও অনেক নাম না জানা বীর সন্তান প্রাণ হারাল। শহীদের রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হলো। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের পথ আরও তীব্র গতি পেল। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষায় স্বীকৃতি দেয়।
৫. প্রশাসনিক ক্ষেত্রে : পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থার প্রথমদিক থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি জনগণ বেশি সুযোগ লাভ করে আসছিল। এর ফলে কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কাঠামোতে পূর্ব পাকিস্তানের অনুপস্থিতি তীব্রভাবে অনুভূত হয়। ১৯৫৮ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী প্রশাসনিক ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যা ছিল ১৯ জন সচিবের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে একজনও না। ৪১ জন যুগ্ম সচিবের মধ্যে ৩ জন এবং উপসচিবদের ৩৩ জনের মধ্যে ১০ জন ছিল বাঙালি। ১৯৫৮ সালের আইয়ুব খানের
ক্ষমতা দখলের পর চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি প্রবর্তন করলে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা কিছুটা উন্নতি হয় ।
৬. শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য : পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট বৈষম্য দেখা যায়। পূর্ব পাকিস্তানিদের শিক্ষার ব্যাপারে প্রচুর উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়। পক্ষপাতমূলক উন্নয়ন, কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক ব্যয় ও বেসামরিক ব্যয় সামরিক ক্ষেত্রে বৈষম্য, বেসামরিক চাকরির বৈষম্য এবং নানাবিধ সামাজিক কারণে বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রের
আবির্ভাব ঘটে।
৭. শিল্পক্ষেত্রে বৈষম্য : পাকিস্তানের পশ্চিম ও পূর্ব উভয় অংশে শিল্পপ্রতিষ্ঠায় বৈষম্যমূলক নীতির ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের পরিমাণ দিনদিন বৃদ্ধি পায়। পূর্ব পাকিস্তানে তেমন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠায় এ অঞ্চলের শিল্পজাত্যদ্রব্যের উৎপাদন ছিল কম। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠায় সেখানে শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদন ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। যেমন- ১৯৪৯-৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে মোট উৎপাদন ছিল ৯.৪ভাগ আর
পশ্চিম পাকিস্তানে এ হার ছিল মোট উৎপাদনের ১৪.৭%। আবার ১৯৬৯-৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে মোট উৎপাদন ছিল
২০% পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল মোট উৎপাদনের ২-৩%।
৮. কৃষিক্ষেত্রে : কৃষি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য সুস্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। পূর পাকিস্তানে মূলত ধান, পাট, চা উৎপাদিত হয় এবং এর উপর ভিত্তি করেই পাকিস্তানিদের অর্থনৈতিক কাঠামো দৃঢ়তা লাভ করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের উৎপন্ন দ্রব্য রপ্তানি দ্বারা পাকিস্তানের বৈদেশিক আয়ের ৫০/৭০ ভাগ অর্জিত হতো। অথচ
বৈদেশিক আমদানির ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ২৫/৩০ ভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কৃষির সিংহভাগই পশ্চিম পাকিস্তানের কৃষকদের প্রদান করা হতো। ১৯৪৭-৭০ সাল পর্যন্ত কৃষিক্ষেত্রে যে বৈষম্য সৃষ্টি হয় তা ব্যাপক অসন্তোষের সৃষ্টি করে। নিম্নে ১৯৪৭–৭০ সাল পর্যন্ত কৃষিক্ষেত্রে বৈষম্যের চিত্র দেয়া হলো :
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় যে, বাংলাদেশের আবির্ভাব ছিল অত্যন্ত বাস্তব। একদিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণ এবং অন্যদিকে বাঙালিদের ইস্পাত কঠিন আন্দোলন পাকিস্তানের ভাঙনকে ত্বরান্বিত করে। কেন্দ্রীয় সরকার প্রশাসন অর্থনৈতিক, সামরিকবাহিনী, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক
প্রতিষ্ঠা ক্ষেত্রেই বাঙালিদের যথাযথ অংশগ্রহণের অধিকারকে অস্বীকার করলে যে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়, তার ফলে বাঙালিদের
মধ্যে স্বাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ধাপ পেরিয়ে আরো সুসংহত হয় এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। সুতরাং, ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরেই ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটে।