বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জনশক্তি রপ্তানির গুরুত্ব ও তাৎপর্য
আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জনসংখ্যা রপ্তানির প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা কর।
অর্থবা, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জনসংখ্যা রপ্তানির প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর।
উত্তর ভূমিকা : একটি দেশ গঠনের জন্য যে কয়েকটি উপাদান অপরিহার্য, জনসংখ্যা তন্মধ্যে অন্যতম। জনসংখ্যা হচ্ছে একটি দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জনসংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করে। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্বিত করতে হলে শ্রমশক্তি
অপরিহার্য আর জনসংখ্যাই হলো এর উৎস।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জনশক্তি রপ্তানির গুরুত্ব : নিম্নে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জনশক্তি রপ্তানির গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :
১. বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন : বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে অধিকহারে বৈদেশিক মুদ্রার্জন করা সম্ভব। অনেকক্ষেত্রে এটা আমাদের মোট রপ্তানি আয়কে ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমান দক্ষ, আধাদক্ষ, অদক্ষ শ্রমশক্তির একটি বৃহৎ অংশ বিদেশে কর্মে নিয়োজিত আছে । বস্তুত বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধানতম উৎস হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। ২০০৮-০৯ এবং ২০০৯-১০ সালে প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৯৬৮৯.১৬ এবং ৮২৭০.০৪ মিলিয়ন
ডলার। ফলে শ্রমশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা’ আমাদের অর্থনীতির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৮ এবং ২০০৯
সালে বৈধভাবে নিয়োজিত বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৮,৭৫,০৫৫ ও ৪,৭৫,২৭৮ জন। তবে বাংলাদেশের
শ্রমশক্তির দক্ষতা বাড়াতে পারলে ভবিষ্যতে আরও অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে বৈধভাবে বিদেশে
কাজ করতে যাওয়ার জন্য সরকারকে উৎসাহিত করতে হবে এবং সরকারকে সরাসরি সহায়তা প্রদান করতে হবে।
২. মানবসম্পদ উন্নয়ন : শ্রমশক্তি রপ্তানি মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন করা যায়। বিদেশি কার্যে নিয়োজিত প্রবাসীদের, চিন্ত
চেতনা, ধ্যানধারণা, দক্ষতা সচেতনতা ইত্যাদির উন্নতি ঘটে। তাদের সন্তানেরা যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠার সুযোগ লাভ করে ।
৩. লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতি পূরণ : বাংলাদেশ রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি করে। ফলে আন্তর্জাতিক
বাণিজ্যে বাংলাদেশে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ অধিক। প্রায় প্রত্যেকটি দেশের সাথে এ বাণিজ্য ঘাটতি বিরাজমান।
বিদেশি বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিটেন্স এ বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০০৯-১০
সালে প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৮২৭০.০৪ মিলিয়ন ডলার যা ঐ সালের ভারসাম্য ঘাটতি দূর
করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪. উদ্যোক্তা শ্রেণির উদ্ভব : বিদেশে কর্মরত অনেক প্রবাসী তাদের উপার্জিত অর্থ দ্বারা এদেশে শিল্পকারখানা গড়ে
তুলছে। একদিকে তারা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে অপরদিকে, কলকারখানা স্থাপন করে অনেক
লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব দূরীকরণে সহায়তা করছে।
৫. জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান : বাংলাদেশ জনাধিক্য সমস্যায় জর্জরিত। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে এ সমস্যার আংশিক সমাধান সম্ভব। বর্তমানে বৈধভাবে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ৪,৭৫,২৭৮ জন। ক্রমে আরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান হলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জনসংখ্যার চাপ কিছুটা প্রশমিত
হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। শ্রমশক্তি রপ্তানি করলে একদিকে রেমিটেন্স আন্তঃপ্রবাহের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে সবল রাখবে অন্যদিকে, জনসংখ্যার মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ কমাবে।
৬. বেকার সমস্যার সমাধান : বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ বেকার, তাই শ্রমশক্তি রপ্তানি করা ছাড়া বেকারত্ব দূরীকরণের আর কোনো পথ নেই।
৭. দক্ষতা বৃদ্ধি : শ্রমশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে গড় দক্ষতা স্তর উন্নতি করা সম্ভব। বাংলাদেশের শ্রমিকেরা উন্নত দেশে নিয়োগ লাভ করতে পারলে উন্নত প্রযুক্তি ও কলকব্জার সাথে পরিচিত হয়, ফলে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। এসব শ্রমিক পরবর্তীতে দেশে ফিরে আসলে দেশের অভ্যন্তরে দক্ষ শ্রমশক্তি বৃদ্ধি পায়।
৮. আকাশ পথের আয় বৃদ্ধি : অধিকহারে শ্রমশক্তি রপ্তানি করা হলে অধিকহারে যাত্রী আকাশ পথ ব্যবহার করবে। ফলে বাংলাদেশ বিমান খাতের আয় বৃদ্ধি পাবে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জনশক্তি রপ্তানির গুরুত্ব অপরিসীম। এ জনশক্তি রপ্তানির ফলে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে, তেমনি আন্তর্জাতিক লেনদেন ভারসাম্যেও বিরাট উন্নতি সাধিত হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জনশক্তি রপ্তানির গুরুত্বকে কোনো অংশে খাটো করে দেখা যায় না।