বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব বা ভূমিকা আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির ভূমিকা আলোকপাত কর।
অথবা, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
কৃষি পৃথিবীর প্রাচীন ও বৃহত্তম শিল্প। কৃষিকে অবলম্বন করেই মানবসভ্যতার যাত্রা শুরু। বর্তমানে পৃথিবীর উন্নয়নশীল বেশিরভাগ দেশেই কৃষিকাজ প্রধান পেশা হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের
অধিবাসীদেরও প্রধান পেশা কৃষি বা কৃষিকাজ। কারণ এ দেশের শতকরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভারে ৮০ জন লোক তাদের জীবিকার উৎস হিসেবে কৃষিব্যবস্থাকে বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বীজ এ কৃষি সম্পদের উন্নয়নের ভিতরেই নিহিত।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব বা ভূমিকা : বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় এ দেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে কৃষি সম্পদের উপর নির্ভরশীল। নিম্নে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব বা ভূমিকা আলোচনা করা হলো :
১. প্রধান পেশা : জীবিকানির্বাহের জন্য বাংলাদেশের এক বিরাট জনগোষ্ঠী কৃষির উপর নির্ভরশীল। জীবনধারণের জন্য কৃষির উপর জনসাধারণের এত অধিক নির্ভরশীলতা এ দেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্বেরই সাক্ষ্য দেয়।
২. খাদ্যের যোগান : বাংলাদেশের কৃষিসম্পদ দেশের খাদ্য চাহিদা মেটায়। একমাত্র কৃষির উন্নয়নের মাধ্যমেই খাদ্যঘাটতি দূর এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব।
৩. জাতীয় উৎপাদনের প্রধান উৎস : কৃষি এখনও আমাদের মোট জাতীয় উৎপাদনের শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ আয় করতে সাহায্য করে। অন্যান্য খাতের ক্রম উন্নতির ফলে জাতীয় উৎপাদনে কৃষির অবদান ক্রমান্বয়ে কমে আসলেও একথা সত্য যে, এখনও দীর্ঘকাল ধরে কৃষিখাতের প্রাধান্য বজায় থাকবে।
৪. শিল্পের জন্য কাঁচামালের যোগান : দেশে যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং যেগুলো প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তাদের বেশির ভাগেরই প্রয়োজনীয় কাঁচামালের যোগান মূলত কৃষি থেকে আসে। পাট, ইক্ষু, চা, তামাক প্রভৃতি কৃষিজাত কাঁচামালগুলোর উপর ভিত্তি করেই আমাদের পাট, চিনি, চা ও সিগারেট শিল্প গড়ে উঠেছে।
৫. বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা : বাংলাদেশের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিভিন্ন প্রকার কৃষিজাত দ্রব্য রপ্তানি করে আয় করা হয়। তাই অধিক পরিমাণে কৃষিজাত দ্রব্য রপ্তানি করতে পারলে পর্যাপ্ত পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে এবং তা শিল্পোন্নয়নের কাজে ব্যয় করা সম্ভব হবে।
৬. শিল্পজাত দ্রব্যের বাজার সৃষ্টি : কৃষির উন্নতির সাথে সাথে কৃষকদের আয় বৃদ্ধি পায় এবং শিল্পজাত দ্রব্যের জন্য তাদের চাহিদা বাড়ে। এ চাহিদা মিটানোর জন্য দেশে বিদ্যমান কলকারখানাগুলোর প্রসার ঘটে ও নতুন নতুন শিল্পকলকারখানা গড়ে উঠে। তাই দেশে শিল্পায়নের জন্য কৃষির উন্নয়ন একান্ত প্রয়োজন ।
৭. কৃষি সহায়ক শিল্প স্থাপনের প্রবণতা বৃদ্ধি : কৃষির উন্নতির সাথে সাথে কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার, কীটনাশক ওষুধ, গভীর ও অগভীর নলকূপ, ট্রাক্টর ইত্যাদি কৃষি উপকরণের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে দেশে ঐসব উপকরণ প্রস্তুতকারী শিল্প গড়ে উঠে। তাই বাংলাদেশে কৃষির উন্নতির উপরই কৃষি সহায়ক শিল্প কলকারখানা স্থাপনের সম্ভাবনা নির্ভর করছে।
৮. সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধি : বাংলাদেশ সরকারের আয়ের একটি বিরাট অংশ কৃষিখাত থেকে আসে। জমির খাজনা, কৃষি আয়কর, কৃষিপণ্য পরিবহণের ভাতা, কৃষিজাত পণ্যের উপর রপ্তানি শুল্ক ইত্যাদি বাবদ সরকারের যথেষ্ট আয় হয়।
৯. বস্ত্রের সংস্থান : কৃষি আমাদের দেশের জনগণের বস্ত্রের সংস্থান করে। পাট, তুলা, ভেড়ার লোম ইত্যাদি আঁশ জাতীয় কৃষিপণ্য থেকে বিভিন্ন ধরনের কাপড় প্রস্তুত করা হয়। এগুলো এ দেশের জনগণের বস্ত্রের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করে।
১০. ওষুধ শিল্প প্রতিষ্ঠান : কৃষি থেকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের কাঁচামাল পাওয়া যায়। এ দেশের আনাচে কানাচে ও বনাঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের লতাপাতা ও গাছগাছড়া পাওয়া যায়। এগুলোর উপর নির্ভর করে এ দেশের সুপ্রাচীন হেকিমি শিল্প গড়ে উঠেছে ।
১১. বাসস্থান ও জ্বালানির উপকরণ সরবরাহ : বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ বাসস্থানই খড়, শন, পাতা, বাঁশ, বেত প্রভৃতি উপকরণ দ্বারা তৈরি করা হয়। এ উপকরণগুলো কৃষিই যোগায়। তাছাড়া গাছপালা ও শুকনো পাতা, পাটখড়ি, শস্যের ভুশি, নোদা প্রভৃতি আমাদের জ্বালানির চাহিদাও বহুলাংশে পূরণ করে। এগুলোর উৎসও কৃষি ।
১২. দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন : বাংলাদেশের জাতীয় উৎপাদনে একক খাত হিসেবে কৃষিখাতের অবদান উল্লেখযোগ্য। কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে আমাদের অভ্যন্তরীণ সম্পদ দ্বারা অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্রমবর্ধমান ব্যয়ভার মিটানো সম্ভব। সুতরাং, এ খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে দ্রুত অর্থনেতিক উন্নয়ন ঘটানো যায়।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কৃষিই আমাদের জাতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড। কৃষির উন্নতির মাধ্যমেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আনয়ন সম্ভব। আমাদের জাতীয় আয়ের অর্ধেকই আসে কৃষি হতে এবং রপ্তানি বাণিজ্যের শতকরা প্রায় ১৪ ভাগই হলো কৃষিজাত পণ্য। আমাদের অর্থনীতিতে তাই কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম । কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের কৃষি নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। আমাদের কৃষি সমস্যামুক্ত হলে কৃষি উৎপাদন বাড়বে এবং জাতীয় উন্নয়নের পথও প্রশস্ত হবে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%b8%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%97%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%80%e0%a6%a3-%e0%a6%b8%e0%a6%ae/