অথবা, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর দার্শনিক মতবাদসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর দার্শনিক মতবাদসমূহ তুলে ধর।
অথবা, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর দার্শনিক মতবাদসমূহ ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সাহিত্য ও দর্শনের ভুবনে মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ (১৮৯৮-১৯৭৪) এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। তিনি জন্মগ্রহণ করেন পাবনা জেলার শাহজাদপুর থানার অন্তর্গত ঘোড়াশাল গ্রামে এবং পড়াশোনা ও ডিগ্রি লাভ করেন দর্শন ও আইনশাস্ত্রে । প্রশাসনিক গুরুদায়িত্ব ও ক্লান্তিকর কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তিনি পূর্বাপর
নিষ্ঠার সাথে নিয়োজিত থাকেন সাহিত্যকর্ম ও দর্শনচর্চায়। বরকতুল্লাহ ‘পারস্য প্রতিভা’ গ্রন্থটি লিখে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। এছাড়াও ইসলামের আদিযুগ, ফার্সি সাহিত্য এবং দর্শনের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি কয়েকটি গ্রন্থ ও অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দার্শনিক ঐতিহ্য ও সাহিত্যের সাথে সম্যক পরিচিত ছিলেন। তিনি জগৎ ও জীবনের দার্শনিক প্রশ্ন নিয়ে ভাবিত হয়েছিলেন। নিম্নে তাঁর দার্শনিক মতবাদসমূহ আলোচনা করা হলো :
বিশ্বময় চেতনা : অন্যান্য দার্শনিকদের মতো বরকতুল্লাহও ভাবিত হয়েছেন জগৎ ও জীবন, জড় প্রকৃতি ও মনোজগৎ, আত্মা ও পরমাত্মা, ইহলোক ও পরলোক প্রভৃতি দার্শনিক প্রশ্ন দ্বারা। এসব প্রশ্নের উত্তরানুসন্ধান করতে গিয়ে
প্রথমেই তিনি সত্য ও বাস্তব বলে গ্রহণ করেছেন এক বিশ্বময় চেতনার বাস্তবতাকে, এক নিয়ত বিকাশমান প্রাণলীলার উপস্থিতিকে। এটি নিতান্তই তাঁর একটি প্রত্যয়। আর একে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষে তিনি প্রয়োগ করেছেন তাঁর প্রাঞ্জল প্রসাদগুণযুক্ত ভাষা ও দার্শনিক যুক্তিমালা। তাঁর মতে, এ সর্বময় প্রাণলীলার প্রভাবেই চুম্বক আকর্ষণ করে লোহাকে, অণু পরমাণু থাকতে চায় একত্রিত হয়ে এবং গ্রহ ও নক্ষত্রপুঞ্জ অবিরাম আবর্তিত হয়ে চলেছে মহাকর্ষের প্রভাবে। এ চেতনা ও
প্রাণলীলার পাশাপাশি আবার প্রবহমান রয়েছে আরেকটি ধর্ম, যাকে বরকতুল্লাহ অভিহিত করেছেন আত্মপ্রতিষ্ঠার ধর্ম বলে।
বস্তুজগতের এ আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাই অধিকতর ব্যাপক ও সংহত জীবজগতে। জীব শুধু বেঁচে থেকেই সন্তুষ্ট হয় না, নিজেকে প্রসারিত করতে চায় কালের প্রবাহে। তার এ প্রয়াসই মূর্ত হয়ে উঠে সন্তান বাৎসল্য তথা বংশবৃদ্ধির বাসনায়। ঠিক একই বাসনা আবার মানুষের পর্যায়ে অভিব্যক্ত হয় আত্মার শক্তি বলে। আত্মা অমরত্বের দাবিদার, মৃত্যুতে
দেহবিনাশের পরও সে টিকে থাকতে চায়। বরকতুল্লাহ বলেছেন, কি প্রকৃতি, কি প্রাণিজগৎ দেহবিনাশের পরও সে টিকে
থাকতে চায়। বরকতুল্লাহ বলেছেন, কি প্রকৃতি, কি প্রাণিজগৎ সর্বত্রই অগ্রসরমান রয়েছে বিবর্তন প্রক্রিয়া, তেমনি আত্মাও পরলোকে অব্যাহত রাখতে চায় তার আপন অস্তিত্বকে। আত্মা পরলোকে বেঁচে থাকবে এবং আপন কৃতকর্মের ফলাফল ভোগ করবে- এটিই আত্মার এক অলঙ্ঘনীয় আবেদন। এ আকাঙ্ক্ষার ফলেই হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান প্রভৃতি সকল সমাজের মানুষ স্বর্গ সম্পর্কে রচনা করেছে এক মনোহর চিত্র। এ আকাঙ্ক্ষাই নানাভাবে প্রসারিত হয়ে স্থান পেয়েছে বিভিন্ন সমাজের কাব্যকলা, সাহিত্য ও সঙ্গীতে। স্বর্গ সম্পর্কে বরকতুল্লাহর বক্তব্যে দুটি ভিন্নধর্মী যুক্তি লক্ষণীয়। প্রথমে তিনি বিভিন্ন সমাজে উপস্থিত স্বর্গের ধারণাকে
বর্ণনা করেছেন মানুষের পার্থিব জীবনের সকল বঞ্চনা ও অতৃপ্তির ক্ষতিপূরণের প্রয়াস বলে। এরপর আবার তিনি অমরত্বের আকাঙ্ক্ষাকে ব্যাখ্যা করেছেন মানুষের উপর এক মহাপ্রেরণার প্রভাবের ফল বলে। বরকতুল্লাহ বলেছেন, স্বর্গের এ কল্পনাকে মানুষের ইচ্ছাপূরণ আকাঙ্ক্ষার অভিব্যক্তি বলে মনে হলেও আসলে কিন্তু মানুষ একে ইচ্ছামতো সৃষ্টি করে না। এর মূলে রয়েছে সনাতন সত্যের প্রভাব। সে সত্যটি হলো এই যে, জ্ঞান ও বুদ্ধিতে মানুষ যতই সীমাবদ্ধ হোক না কেন বাস্তবকে পেরিয়ে সে অগ্রসর হয় আদর্শের সন্ধানে। আদর্শের প্রতি এই যে আকর্ষণ, বর্তমানকে অতিক্রম করে অনাগতের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রসারণের এই যে ব্যাকুলতা তা কোন বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। বরং প্রবহমান রয়েছে সমগ্র মানবজাতির ভিতর। বরকতুল্লাহর ধারণা এই সচেতন প্রেরণা শুধু সচেতনই নয়, সুনিয়ন্ত্রিত ও সুচলিত বটে। আর এই থেকেই অনুমান করা যায় এর অন্তরালে এক উদ্দেশ্যময় চালকের উপস্থিতি। এই ধরনের একজন চালক আছেন বলেই তো ভবিষ্যৎ চমৎকারভাবে রচিত হয়েছে বর্তমানের উপর আর পলে পলে মুছে যাচ্ছে অতীত। এ একই চেতনা সত্তা দেশকালের প্রেক্ষিতে পরিগ্রহ করছে বহুরূপ ও বিচিত্র প্রকাশভঙ্গিমা। এ পরমসত্তাকেই মুসা,
ঈসা, মুহম্মদ (স) প্রমুখ গ্রহণ করেছেন ‘আল্লাহ’ বলে এবং একেই তাঁরা শনাক্ত করেছেন সবকিছুর আদি উৎস ও চূড়ান্ত লক্ষ্য
বলে। তিনিই দিনের পর দিন স্ফুট থেকে স্ফুটতর হয়েছেন মানুষের চিন্তা ও অনুভূতিতে। এ প্রেমের দেবতাকেই টলস্টয় ও
স্বামী বিবেকানন্দ জাগ্রত দেখেছিলেন মানুষের অন্তরে। ফরাসি মনীষী অগাস্ট কোঁৎ বলেছিলেন, মানুষের মধ্যে জাগ্রত এ দেবতার কথা। কিন্তু কোঁৎ এই দেবতাকে সীমিত করে রেখেছিলেন মানুষের মধ্যে এবং মানুষকেই তিনি চিহ্নিত করেছিলেন মানুষের আদর্শ, মানুষের পূজার লক্ষ্য বলে। কিন্তু বরকতুল্লাহর মতে, বিশ্বময় সনাতন সত্তাকে মানুষের মধ্যে সীমিত রাখা যায় না। মানুষ্যরূপী আদর্শকেই যদি মানুষ নির্বাচন করে তার পূজার লক্ষ্য হিসেবে তাহলে তার সম্মুখ গতির আর অবকাশ থাকে কোথায়? বরকতুল্লাহ বলেছেন, বিশ্বময় চেতন সত্তাকে বস্তুবাদীদের খণ্ডিত দৃষ্টিতে শনাক্ত করা সম্ভব নয়। বস্তুবাদীরা জগৎকে দেখে থাকেন নিষ্প্রাণ জড়বস্তুর নিছক একটি পিণ্ডরূপে। অখণ্ড সত্তাকে তারা দেখাতে চান খণ্ডিত করে। আর তাই জগতের বস্তুরাশির মহাস্তূপের ভিতর প্রাণ সত্তা হলো কীভাবে? এ প্রশ্নের সদুত্তর তাঁরা দিতে পারেন না। তিনি বলেছেন, ধর্মসাধনায়
সিদ্ধি লাভ দ্বারা যিনি চিরজাগ্রত, চিরবিকাশমান চেতনার মধ্যে একবার নিজের স্থান করে নিয়েছেন মরণ তাঁকে স্পর্শ করতে
পারে না। তাইতো ধর্ম এমন এক অসীম খোদায় বিশ্বাসী যিনি মানুষকে ভালোবাসেন, যিনি পাপাত্মাদের দণ্ডবিধান এবং পুণ্যবানদের পুরস্কার প্রদান করেন । ধর্মে বর্ণিত এ খোদা শুধু অনন্ত শক্তিমানই নন, পরম হৃদয়বানও বটে।
অতীন্দ্রিয় অনুভব শক্তি : বর্তমান যুগ বিজ্ঞান প্রযুক্তির অগ্রগতির যুগ। বস্তুবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবিত উন্নতির এ পরিবেশে ধর্মবিশ্বাস যে এক বড় রকমের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, সে সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন ছিলেন বরকতুল্লাহ। তাই এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য ছিল যুক্তিপূর্ণ। বিজ্ঞানমনস্ক সংশয়বাদীরা প্রশ্ন করতে পারেন, জগতের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা বলে কোন পরম সত্তা যদি কেউ একজন থেকেও থাকেন, তবে তাঁর সাথে সসীম মানুষের পক্ষে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব কী করে? বরকতুল্লাহর উত্তর, “ক্ষুদ্র শিশির বিন্দুতে মহাসূর্য প্রতিবিম্বিত হয়। মানুষের দেহনিবদ্ধ সীমাবদ্ধ মনেও তেমনি ইন্দ্রিয়পথ ছাড়া অন্য পথে বিশ্বমনের একটু জ্যোতিঃকণা প্রতিফলিত হবে এ আর বিচিত্র কী?”
অসীমের সাথে সসীমের যোগাযোগ সম্ভব, একথা মেনে নিলেও প্রশ্ন থেকে যায় এ যোগাযোগের উপায় কী? উত্তরে বরকতুল্লাহ বলেছেন, সহজ ইন্দ্রিয় সংস্কার, বুদ্ধি প্রভৃতি আমাদের জ্ঞানের প্রচলিত বাহন। কিন্তু এদের সাহায্যে পরমসত্তার সাক্ষাৎ জ্ঞান পাওয়া যায় না। তাই বলে যে সে সত্তা অজ্ঞেয় বা অজ্ঞাত এমন কথা বলা চলে না। কারণ এগুলো ছাড়াও মানবমনের অন্য একটি শক্তি আছে বরকতুল্লাহ যার নাম দিয়েছেন অতীন্দ্রিয় অনুভবশক্তি বা স্বজ্ঞা (Intuition)। স্বজ্ঞার
সাহায্যে আমরা সরাসরি অবহিত হই আমাদের নিজ নিজ অস্তিত্ব ও চেতনা সম্পর্কে। এ স্বজ্ঞা যখন পরিণত অবস্থায়
উপনীত হয়, তখন এর আলোকেই মানুষ দেখতে পায় পরমসত্তাকে এবং উপলব্ধি করতে পারে সে সত্তার সাথে তার নিজের সম্বন্ধকে। স্বজ্ঞা ও স্বাজ্ঞিক জ্ঞানের স্বরূপ নিয়ে দার্শনিক মহলে বিতর্কের অবধি নেই। যুক্তিবাদী বিচারে স্বজ্ঞার সন্ধান পাওয়া যায় না। তাই যুক্তিবুদ্ধির কাছে স্বজ্ঞার কোন জ্ঞানীয় মূল্যই নেই। কিন্তু স্বজ্ঞাবাদীরা স্বজ্ঞাকে স্থান দেন যুক্তির ঊর্ধ্বে সে অখণ্ড উষ্ণতর অনুভূতির পর্যায়ে যেখানে খণ্ডবুদ্ধি ও নৈয়ায়িক যুক্তির বিচরণ অসম্ভব। এ বিতর্ক প্রাণবন্ত রয়েছে যুগযুগান্তর ধরে। কিন্তু এর মীমাংসার কোনও লক্ষণ দেখা যায় না আজ পর্যন্ত। বরকতুল্লাহ স্বজ্ঞা শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন প্রগাঢ় মরমি অভিজ্ঞতার অর্থে, রাসেলের ‘A lazy man’s philosophy’ অর্থে নয়। বস্তুত স্বজ্ঞা বলতে বরকতুল্লাহ সুফি বা
যোগীদের নিছক নিষ্ক্রিয় ধ্যান অনুধ্যানকে বুঝেননি, বুঝেছেন কাণ্ডজ্ঞান ও ভেদবুদ্ধি উত্তীর্ণ জ্ঞানের সে উচ্চতর ও অধিকতর
ফলপ্রসূ বাহনকে যার কথা বলেছেন বার্গসোসহ অন্যান্য স্বজ্ঞাবাদী দার্শনিকগণ। জ্ঞানের এ বাহন কোন আপতিকভাবে প্রাপ্ত
কিংবা সহজলভ্য ব্যাপার নয়। একে অর্জন করতে হয় সুকঠিন অনুশীলন ও অধ্যবসায়ের দ্বারা, বরকতুল্লাহর ভাষায় ‘কঠোর৷তপস্যার’ মাধ্যমে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বরকতুল্লাহ বিশ্বময় চেতনা ও সনাতন সত্যের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে তাঁর ভাববাদী ও অধ্যাত্মবাদী মনোবৃত্তির পরিচয় সুস্পষ্ট এবং একই সাথে তাতে আবার অভিব্যক্ত হয়েছে
প্রচলিত ধর্মানুভূতি ও ধর্মীয় অভিজ্ঞতার প্রতি তাঁর প্রগাঢ় আস্থা। এছাড়া অতীন্দ্রিয় অনুভূতির ভিত্তি ও উৎপত্তি সহজেন্দ্রিয় ও বুদ্ধির অধিগম্য নয়; একথা অন্যান্য সকল ফরাসিবাদীর ন্যায় বরকতুল্লাহও বলেছেন। তবে জ্ঞানের বাহন হিসেবে বুদ্ধিকে তিনি অকেজো বলে বাতিল করে দেন নি; তিনি বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা এবং সে ক্ষেত্রে অতীন্দ্রিয়
অনুভূতির প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করেছেন। আর এ মূল্যবান অবদানের জন্য তিনি বাংলাদেশ দর্শনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।