বঙ্গভঙ্গের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর।

উত্তর৷ ভূমিকা : ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গের কারণ ও ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি বিভিন্ন কৌশলপ্রয়োগ করে তাদের শোষণ ও শাসন দীর্ঘস্থায়ী করতে সচেষ্ট থাকে। এরূপ অপকৌশলের অন্যতম উদাহরণ হলো ১৯০৫ সালে বঙ্গকে ভঙ্গ করা। প্রশাসনিক সুবিধার অজুহাতে লর্ড কার্জন বাংলা প্রেসিডেন্সী বিভক্ত করেন। মূলত এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক স্বার্থচরিতার্থ করা। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও আসামকে নিয়ে পূর্ব বাংলা ও আসাম নামে একটি প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়। যার রাজধানী করা হয় ঢাকা। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যাকে নিয়ে গঠিত হয় বাংলাপ্রদেশ যার রাজধানী হয় কোলকাতা। এটাই ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত।
বঙ্গভঙ্গের কারণ : বঙ্গভঙ্গের পশ্চাতে বহুবিধ কারণ নিহিত ছিল। নিচে বঙ্গভঙ্গের কারণ বর্ণনা করা হলো :
১. ভৌগোলিক কারণ : তদানীন্তন ভারতে বাংলা ছিল সর্ববৃহৎ প্রদেশ। বাংলা প্রদেশের আয়তন ছিল ১ লক্ষ ৮৯ হাজার বর্গমাইল আর জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৫০ লক্ষ (আদমশুমারি ১৯০১)। এ বিশাল আয়তনের প্রদেশকে কেন্দ্র থেকে শাসন করা খুবই অসুবিধাজনক হয়ে পড়ে। মূলত এ বিশাল আয়তনের প্রদেশের সুশাসন নিশ্চিত করা ভৌগোলিক দিক থেকে একজন প্রশাসকের পক্ষে খুবই দুষ্কর হয়ে পড়ে। ফলে বঙ্গভঙ্গের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।”
২. প্রশাসনিক কারণ : বড়লাট কার্জন উপলব্ধি করেন যে পূর্ব-বাংলা ও আসাম নিয়ে একটি প্রদেশ গঠিত হলে প্রশাসনিক সমস্যা হবে বরং এ অনুন্নত অঞ্চলের জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, ব্যবসায় বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নতির পথ সুগম হবে।
৩. রাজনৈতিক কারণ : বঙ্গভঙ্গের অন্যতম প্রধান কারণ লো রাজনৈতিক। ব্রিটিশ সরকার অনুভব করে যে, ব্রিটিশ বিরোধ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল বঙ্গ। ফলে বঙ্গকেন্দ্রিক ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারকে চিন্তিত করে তোলে। ফলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দমনে বাঙালি জাতীয়তাবাদে আঘাত হানে। সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে মুসলমানদের মধ্যে ব্রিটিশ প্রীতি সৃষ্টির ফলে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার সুবিধা ভোগ করে।
৪. অর্থনৈতিক কারণ : বঙ্গভঙ্গের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল অর্থনৈতিক। তৎকালীন সময়ে ব্যবসায় বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল কোলকাতা। ফলে পূর্ব বাংলার জনগণ বিশেষকরে মুসলমানরা সর্বদিকে পিছিয়ে পড়ে। তাই কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মুসলমানদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা, ব্যবসায় বাণিজ্য বৃদ্ধি করতে বঙ্গভঙ্গ করা হয়। ফলে পূর্ব বঙ্গের জনতা বঙ্গভঙ্গের ফলে অনুপ্রাণিত হয়।
৫. সামাজিক কারণ : ব্রিটিশরা মুসলমানদের কাছ থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়। এ কারণে মুসলমানদের ব্রিটিশরা সন্দেহের চোখে দেখতো। ফলে কার্যত মুসলমানরা সর্বদিকে পিছিয়ে পড়ে। ফলে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে মুসলমানদের৷মধ্যে নতুন আশা সৃষ্টি হয়।
৬. ধর্মীয় কারণ : পূর্ব বাংলায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং পশ্চিম বাংলায় হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ধর্মীয় দিক থেকে পূর্ব বাংলার জনসাধারণের একটি দাবিও ছিল। তাই ধর্মীয় দিক থেকে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ করার জন্য তৎপর হন।
বঙ্গভঙ্গের ফলাফল : বাংলার রাজনীতিতে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। নিচে বঙ্গ- ভঙ্গের ফলাফল উপস্থাপন করা হলো :
১. মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া : পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে বঙ্গভঙ্গ ছিল আশীর্বাদ স্বরূপ। কারণ বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ ব্রিটিশদের উদ্যোগকে স্বাগত জানান। এছাড়া বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকা পূর্ববঙ্গের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে পরিণত হয় এবং নতুন রাজধানী ঢাকাতে সচিবালয়, হাইকোর্ট, আইন পরিষদ ভবন, নতুন নতুন সুরম্য অট্টালিকা এবং রাস্তাঘাট নির্মিত হতে থাকে। এছাড়া পূর্বে মুসলমান ছেলেরা ডিগ্রি পাস করেও ভালো চাকরি পেত না কিন্তু নতুন প্রদেশে নতুন চাকরির সুযোগ লাভ করেছিল। ফলে মুসলমানরা শিক্ষা দীক্ষা, চাকরি প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সকলক্ষেত্রে
উন্নতি অর্জন করে।
২. হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া : ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে মুসলমানরা আনন্দে উচ্ছসিত হয়। কিন্তু হিন্দু, জমিদার ব্যবসায়ী, বণিক সমিতি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বঙ্গভঙ্গকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের একটি নীতি হিসেবে গ্রহণ করে। কারণ তারা মনে করে যে, এটা ছিল হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে উদীয়মান বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধ্বংস এবং ভারতের রাজনৈতিক যাত্রাকে বাধা প্রদান করার চক্রান্ত। সুতরাং তারা বঙ্গভঙ্গ রদের দাবি করেন এবং বাংলা সাহিত্য,
ভাষা, সংস্কৃতি তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে রক্ষার নামে একটি তীব্র স্বদেশি আন্দোলন গড়ে তোলেন। ফলে অতিদ্রুত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে উঠে ব্রিটিশ শাসনের ভীতকে কাঁপিয়ে তোলে এবং সরকার বঙ্গভঙ্গকে টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়।
৩. সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি : বাংলা প্রেসিডেন্সি ছিল অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। বহু জাতি বহু বিচিত্র ভাষাভাষী মানুষ এখানে বসবাস করতো। যা ছিল তাদের ঐক্যবোধের মূল চাবিকাঠি। আর এ ঐক্যবোধ ব্রিটিশ শাসনের জন্য সুখবর ছিল না। তাই তারা বুঝতে পারেন যে, বাংলা প্রেসিডেন্সির জনসাধারণের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়িয়ে দিতে পারলে আর কোনো দিন তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। তাই সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের সুপারিশ করেন। বঙ্গভঙ্গের ফলে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়।
৪. জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা : বঙ্গভঙ্গের ফলে দুই শ্রেণির দু’ধরনের মানসিকতা লক্ষ করা যায়। দেখা যায় যে, মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের মধ্যে জাতীয় চেতনার সঞ্চার ঘটান এবং এ সিদ্ধান্ত বহাল রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান।
৫. হিন্দু নেতাদের প্রেরণায় স্বদেশি আন্দোলন : বঙ্গভঙ্গকে হিন্দু নেতারা বঙ্গ মাতার অঙ্গচ্ছেদন বলে বর্ণনা করেন।
অনেকে বঙ্গভঙ্গকে ব্রিটিশ সরকারের রাজনৈতিক চক্রান্ত বলে মনে করেন। জাতীয়তাবাদী অনেক রাজনীতিবিদদের ধারণা হলো যে ব্রিটিশ সরকার তাদের যে জাতীয়তাবোধ তা ধ্বংস করার জন্য এ কাজ করার পক্ষে মতামত দিচ্ছেন। তাই তারা
জাতীয়তাবোধকে রক্ষা করার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। ফলে এক পর্যায়ে এটা স্বদেশি আন্দোলনে পরিণত হয়।
৬. সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন : বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদী নেতারা ভারত মাতাকে কালী আখ্যা দিয়ে বঙ্গ মাতার অঙ্গচ্ছেদ বলে আখ্যায়িত করেন। তারা বঙ্গ ভঙ্গের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শুরু করে। এতে বিভিন্নস্থানে গোলযোগ ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়। ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী এ ধরনের এক ঘটনার সাথে
জড়িত ছিলেন বলে তাদের ফাঁসি হয়।
৭. বিলেতি দ্রব্য বর্জন আন্দোলন : বঙ্গভঙ্গের ফলে কলকাতার বাবুদের ব্যবসায় বাণিজ্যের স্বার্থে আঘাত লাগে। তাই তারা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী প্রচারণায় সামিল হন এবং এক পর্যায়ে তারা স্বদেশি আন্দোলনকে বিলেতি দ্রব্য বর্জন আন্দোলনে পরিণত করার হুমকি দেন। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হন বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে। ফলে বড় লাট হার্ডিঞ্জের শাসন আমলে দিল্লির রাজদরবারে সম্রাট ৫ম জর্জের রাজ্যাভিষেক উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গভঙ্গরোধ করা হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মুসলমানদের কাছে বঙ্গভঙ্গ ছিল আশীর্বাদস্বরূপ তারা বঙ্গভঙ্গকে সাদরে গ্রহণ করে। অন্যদিকে হিন্দুরা একে বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদন বলে অভিহিত করে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলে। ফলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। পক্ষান্তরে ব্রিটিশ সরকার রাজনৈতিক স্বার্থচরিতার্থ করতে বঙ্গভঙ্গ করেন । কাজেই বঙ্গভঙ্গ ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় দখল করে আছে।