বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে কত সালে ‘হত্যা’ করা হয়? এ হত্যাকাণ্ডের সুদূরপ্রসারী ফল আলোচনা কর।

অথবা, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে কত সালে হত্যা করা হয়? এ হত্যাকাণ্ডের পর যে আদর্শিক
পরিবর্তন হয় তা আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বাঙালি জাতির স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জন করে। লাভ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালে ১২ জানুয়ারি তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনা শুরু করে এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত তা বলবৎ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর
একদিকে যেমন তার শত্রুরা এর চেতনাকে বিনষ্ট করতে সচেষ্ট ছিল তেমনিভাবে বঙ্গবন্ধুর নেওয়া কিছু পদক্ষেপ জনমনে অশান্তি সৃষ্টি করেছিল বলে সমালোচকেরা দাবি করেন। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে কিছু বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা কর্তৃক নিষ্ঠুরভাবে শাহাদাত বরণ করেন। এর পিছনে অনেক ঘটনা জড়িত থাকলে পণ্ডিতগণ ভিন্ন মতাবলম্বী হওয়ায় এর পক্ষে বিপক্ষে অনেক মত প্রচলিত আছে। নিচে প্রশ্নালোকে বিস্তারিত আলোকপাত করা হলো :
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিনষ্ট করা।
ড. মুনতাসির মামুন ও মাহবুবুর রহমান বলেন, “এ হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শুধু সংবিধান থেকে নয়, বাঙালির মন থেকে মুছে ফেলা।”
এ হত্যাকাণ্ডের পর বাঙালি জাতীয় জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। যে জনপ্রিয়তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শাসনকার্য শুরু করেন তা ধরে রাখতে পারেননি বলে অনেকে মত দেন।
এ হত্যার সুদূরপ্রসারী ফল/ আদর্শিক পরিবর্তন : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করা হয়। এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসও অনেক বিকৃত করা হয়। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলে কুঠারঘাত করা হয়। নিচে প্রশ্ন সম্পর্কে বিস্তারিতৃআলোচনা করা হলো :
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেমন ধ্বংস করার চক্রান্ত করা হয় তেমনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়। বলা হয় ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পূর্ব পর্যন্ত সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয় এবং এর
গুরুত্বপূর্ণ দলিলগুলো ধ্বংস করা হয়।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সুবিস্তৃত পটভূমি ২৩ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সংঘটিত বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক শ্রমিক ও বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণি মানুষ এর অপরিসীম আত্মত্যাগ ও বঙ্গবন্ধুর অনন্য অবদান শত সহস্র বীর মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ, শহিদদের জীবনদান সবকিছু এ সময় বিকৃত করা হয়। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়।
স্বাধীনতার ঘোষক : মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বিতর্ক শুরু হয়। সে সময় মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাকে একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হয়। অন্যদিকে, অপরপক্ষ এর বিরোধিতা করে। ফলে এ নিয়ে বাংলাদেশের দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের বিরোধ
দেখা দেয়। এর মাধ্যমে তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে আড়াল করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে।৷ উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের
স্বাধীনতার ঘোষক।
সংবিধান পরিবর্তন : ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের সময় সংবিধান প্রণেতাগণ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে “জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম” এ অভিধায় অভিহিত করেন। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর হত্যার পর এটাকে পরিবর্তন করা হয়। নতুন সংযোজিত অভিধা করা
হয় “জাতীয় স্বাধীনতার ঐতিহাসিক
মূলনীতি পরিবর্তন : ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সংবিধানের যে চার মূলনীতি ছিল তার পরিবর্তন করা হয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৪ মূলনীতি ছিল-
১. বাঙালি জাতীয়তাবাদ,
৩. গণতন্ত্র ও
২. সমাজতন্ত্র,
৪. ধর্মনিরপেক্ষতা।
এই ৪ মূলনীতি পরিবর্তন করে রাখা হয়।
১. বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ,
২. অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র,
৩. গণতন্ত্র ।
৪. সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস। এভাবে সংবিধানের ৪ মূলনীতির পরিবর্তন করা হয়।
ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল : স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এসে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার অধিকার দেওয়া হয়। এর ফলে জামায়াতে ইসলামীসহ আরো অন্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি দেশ শাসনে : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর পরবর্তী শাসনামলে যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব স্বাধীনতার বিরোধিতা করে তারা দেশের শাসনভার গ্রহণ করে। এভাবে স্বাধীনতার চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়। শাহ আজিজুর রহমান এ সময় প্রধানমন্ত্রী হন। আব্দুল আলীম ও মান্নানের মতো ব্যক্তিরা
মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। এছাড়া যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেছে তাদেরকে তৎকালীন সরকার বিচারের আওতামুক্ত রাখে এবং তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা হয়। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যে দালাল আইন জারি করেন তা পরে রহিত করা
হয় । দালাল আইনে বঙ্গবন্ধু ৭৫২ জনকে দণ্ড প্রদান করেন। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করা হয়। এভাবে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিনষ্ট করা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য বিকৃত করা হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে চেতনা নিয়ে সোনার বাংলা গড়ার জন্য৷ ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণ করেন তা ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট তার সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে বিনষ্ট হয়। বাংলাদেশ হারায় তার জাতীয় স্থপতিকে আর বিশ্ব হারায় এক অবিসংবাদিত নেতাকে। একই সাথে বাংলাদেশ তার মুক্তমনের যে চেতনা ছিল তাও হারিয়ে ফেলে।