বখতিয়ার খলজির রাজ্য বিস্তার আলোচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : বাংলার ইতিহাসে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির নাম অবিস্মরণীয়। তিনি তেরো শতকের
প্রথমদিকে হিন্দু রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে বাংলায় মুসলিম শাসন, প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে বাংলায় এক নতুন দিগন্তের সূত্রপাত ঘটে।
বারো শতকের শেষভাগে সমগ্র উত্তর ভারতব্যাপী মুসলিম | আধিপত্য বিস্তারের যে প্রচেষ্টা চলছিল বখতিয়ার খলজির বাংলা
বিজয় ছিল তারই একটি পূর্বমুখী প্রবাহ। এর মধ্য দিয়ে বাংলার ইতিহাসে হিন্দু রাজত্বের তথা প্রাচিন যুগের অবসান ঘটে এবং শুরু হয় মধ্যযুগের।
→ বিজেতা হিসেবে বখতিয়ার খলজির কৃতিত্ব : বখতিয়ার খলজি ছিলেন উচ্চাভিলাষী। তিনি অযোধ্যার শাসনকর্তা মালিক হুসামউদ্দিন কর্তৃক ভিউলী ও ভাগবত নামক দুটি পরগনার লাভ করার পর থেকেই নিজের ভাগ্য পরিবর্তনে তৎপর হয়ে উঠেন
তিনি অল্পসংখ্যক সৈন্য সংগ্রহ করে পার্শ্ববর্তী, হিন্দুরাজ্যসমূহ আক্রমণ করে অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠন করতে থাকেন। বিশাল সৈন্যবাহিনী গঠনের জন্য তার বিপুল অর্থের প্রয়োজন ছিল। সম্মুখ-সমরে প্রবৃত্ত হয়ে শত্রুপক্ষকে পরাজিত করার মতো সৈন্যবল না থাকায় তিনি গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন
করেন। ধীরে ধীরে বখতিয়ার খলজির বীরত্বের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক ভাগ্যান্বেষী মুসলমান বিশেষত খলজি
গোত্রভুক্ত সৈন্যরা তার সেনাবিহনীতে চাকরি নেয়। এভাবে বখতিয়ার খলজি ক্রমান্বয়ে বিশাল সুদক্ষ এক সেনাবাহিনী গঠন
করেন এবং এ বাহিনীর মাধ্যমে তিনি পরবর্তীতে সফলতা লাভ করেন। নিম্নে বিজেতা হিসেবে বখতিয়ার খলজির কৃতিত্ব
আলোচনা করা হলো :
১. বিহার বিজয় : অদম্য সাহস ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী বখতিয়ার খলজি অন্যান্য তুর্কিদের সমন্বয়ে একটি বিশাল শক্তিশালী বাহিনী গঠন করে সীমান্তবর্তী হিন্দু ফাঁড়ি ও দুর্গগুলোর উপর আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং সম্পদশালী হয়ে উঠেন। এভাবে তিনি শক্তি সঞ্চয় করে ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে
ওদন্তপুর বিহার আক্রমণ করেন। ওদন্তপুর বিহারে বৌদ্ধদের একটি গির্জা ছিল। এর চারদিকে প্রাচীরবেষ্টিত থাকায় বখতিয়ার
খলজি গির্জাটিকে দুর্গ মনে করে অবরোধ করেন এবং প্রায় বিনা বাধায়ই তা অধিকার করেন। দুর্গ জয়ের পর তিনি গির্জায় অবস্থিত মস্তকমুণ্ডিত ব্যক্তিদের নিরীহ স্বভাব দেখে অবাক হন। আসলে স্থানটি কোন দুর্গ ছিল না। এটি ছিল বৌদ্ধদের একটি বিহার। এসময় থেকেই মুসলমানরা ঐ স্থানের নাম দিলেন
বিহার। বিহার অভিযানের সময় বখতিয়ার খলজি প্রচুর ধনরত্ন হস্তগত করেন। অতঃপর অধিকৃত অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।
২. বাংলা বিজয় : বিহার জয়ের পরই ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজি বাংলা (নদীয়া) আক্রমণ করেন। সেন বংশীয় রাজা লক্ষ্মণ সেন এসময় রাজধানী গৌড় ছেড়ে নদীয়ায় অবকাশ যাপন করেছিলেন। নদীয়া আক্রমণে বখতিয়ার অভিনব কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি তেলিয়াগড়ের সুরক্ষিত গিরিপথ পরিহার
করে ঝাড়খণ্ডের গহীন অরণ্যের ভেতর দিয়ে এত ক্ষিপ্রতার সাথে নদীয়া পৌঁছেন যে, মাত্র ১৮ জন সৈন্য তাঁর সাথে আসতে পেরেছিল। সরাসরি প্রাসাদ দ্বারে পৌঁছে তিনি প্রথম আক্রমণেই প্রাসাদ রক্ষীদের হত্যা করেন। ইতোমধ্যে মূল বাহিনী নগরীতে উপনীত হয়। মধ্যাহ্ন ভোজনরত রাজা লক্ষ্মণ সেন প্রাসাদের
পশ্চাৎদ্বার দিয়ে পলায়ন করে সেন বংশীয় প্রাচীন রাজধানী ঢাকার বিক্রমপুরে আশ্রয় নেন। প্রায় বিনা যুদ্ধেই নদীয়া মুসলমানদের হস্তগত হয়।
৩. গৌড় বিজয় : বখতিয়ার খলজি নদীয়া বিজয়ের পর বাংলার রাজধানী গৌড়ের দিকে অগ্রসর হন। রাজমহল থেকে প্রায় ২৫ মাইল নিম্নদিকে গঙ্গা নদীর বামদিকে গৌড় অবস্থিত
ছিল। গৌড় নদীয়ার মতো অরক্ষিত ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও বখতিয়ার খলজি প্রায় বিনা বাধায় গৌড় অধিকার করে নেন। গৌড় বিজয়ের পর বখতিয়ার খলজি এর নাম দেন লখনৌতি এবং এখানে তার রাজধানী স্থাপন করেন।
৪. বরেন্দ্র অধিকার : গৌড় বিজয়ের পর বখতিয়ার খলজি আরো পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে বরেন্দ্র বা উত্তরাবাদ বিজয় সমাপ্ত
করে নিজ অধিকার বিস্তার করেন। অতঃপর বখতিয়ার খলজি তার নব প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের সুশাসনের ব্যবস্থা করেন। তিনি তার
অধিকৃত এলাকাকে নিযুক্ত করেন। তিনি দিনাজপুরের দেবকোটে স্থায়ী রাজধানী স্থাপন করেন। তার রাজ্যে পূর্বে তিস্তা ও করতোয়া
নদী দক্ষিণে পদ্মা নদী, উত্তরে দিনাজপুর জেলার দেবকোট হয়ে রংপুর শহর পর্যন্ত এবং পশ্চিমে বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
৫. তিব্বত অভিযান : বখতিয়ার খলজির দুঃসাহসিক জীবনের শেষ সমরাভিযান ছিল তিব্বত অভিযান। তিনি যখন তিব্বত অভিযানের পরিকল্পনা করেন তখন বাংলার বৃহদাংশ তার অধিকারের বাইরে ছিল। তারপরও তিনি বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে
রাজ্যবিস্তার না করে সুদীর্ঘ ও কষ্টবহুল পথ অতিক্রম করে তিব্বতের ভূখণ্ডসমূহ অধিকার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন
তা বলা কঠিন। সম্ভবত তাঁর দুঃসাহসিক কর্মপ্রেরণাই তাঁকে একটা নতুন ও বীরত্বপূর্ণ কিছু করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল।
অথবা তিব্বতের ভিতর দিয়ে তুর্কিস্তানে যাওয়ার সহজ পথটি আবিষ্কার করাই ছিল তার এ অভিযানের প্রধান উদ্দেশ্য।
যাইহোক বখতিয়ার খলজি সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করার পর দেবকোট থেকে তার বিরাট বাহিনী নিয়ে তিব্বত অভিমুখে যাত্রা করেন। (১২০৬ খ্রিস্টাব্দের শীতকালের শেষের দিকে)। তাঁর
পথপ্রদর্শক পার্বত্য মেচ উপজাতির ধর্মান্তরিত নেতা আলী মেচের নেতৃত্বে তিনি তার সৈন্যবাহিনীকে নিয়ে বাংলার উত্তর পূর্বাঞ্চলীয়
পার্বত্য এলাকার মধ্য দিয়ে কয়েকদিন চলার পর বর্ধনফোট নামক এক শহরে এসে পৌঁছান। দুর্গম পাহাড়ি পথে বখতিয়ারের
বাহিনী কয়েকটি যুদ্ধে জয়লাভ করলেও নানা কারণে সেনাবাহিনী একরূপ বিধ্বস্ত হয়। তিব্বতে অধিকদিন অবস্থান নিরাপদ নয়
মনে করে বখতিয়ার বাংলার পথে প্রত্যাগমন করার সময় তিব্বতীয়রা মুসলমান সৈন্যের পশ্চাদ্ধাবন করে তাদেরকে হতাহত করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত বখতিয়ার একশত অশ্বারোহী সৈন্যসহ বহু কষ্টে দেবকোটে পৌঁছাতে সক্ষম হয় এভাবেই বখতিয়ার খলজির তিব্বত অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।