ফানা ও বাকা সম্পর্কে আলোচনা কর । সুফিবাদে এদের তাৎপর্য কি?

উত্তর : ভূমিকা : সুফিদর্শন একটি আধ্যাত্মিক দর্শন। সুফি সাধকের জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য হলো আল্লাহর সান্নিধ্যে থেকে তার দীদার লাভ করা। এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ায় জন্য সুফিকে অনেক বাধা বিপত্তি পাড়ি দিতে হয় এবং সহ্য করতে হয় অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও দুঃখ, কষ্ট। তারা পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়ী সুখ ও সম্পদের প্রলোভন মুনজেকে মনুষ্যত্বের সাধনায় নিয়োজিত করেন। এই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে পূর্ণমানব হতে হলে সুফিদের কতকগুলো কতকগুলো মৌলিক নীতি অনুসরণ করে চলতে হয়। আর এ মৌলিক নীতিগুলোর মধ্যে ফানা ও বাকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
→ ফানা ও বাকা : সুফিবাদের কতকগুলো মূলনীতি রয়েছে। এই মূলনীতিগুলোর মধ্যে ফানা ও বাকা অন্যতম। নিচে ফানা ও বাকা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১. ফানা : ‘ফানা’ শব্দের অর্থ আত্মবিনাশ। আর এই আত্মবিনাশ মানে আত্মার ধ্বংশ নয়। আত্মগরিমা, হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা লোভ, লালসা, কামনা, বাসনা, নিন্দা, দুনিয়ার ভালোবাসা প্রভৃতি আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা, গুণ ও কার্যাবলিকে পরিত্যাগ করা, মনোবিক গুণ ও আত্মবোধকে ধ্বংস করা, আল্লাহর গুণাবলি লাভ করা এবং সর্বশেষে আল্লাহর অসীম সত্তার মধ্যে বান্দার সসীম সত্তাকে লীন করে দিয়ে নিজ অস্তিত্ববোধ ভুলে যাওয়াকে ফানা বলে। মোটকথা, ফানা তখনই হয় যখন সুফি নিষ্পাপ বা কামনাশূন্য হয়, তখন তার কামনাশূন্য অন্তর আল্লায় ভাবধারণ করে। সেজন্য নিজের অস্তিত্বকে আল্লাহর ভালোবাসায় বিলীন করে দিতে পারলেই ফানা হওয়া সম্ভব। ফানা অবস্থায় সুফি সকলের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে পার্থিব সর্বপ্রকার লোভ ও আশাকে হত্যা করে, নিঃসঙ্গতা পছন্দ করে, সংসারের লাভ ক্ষতি, ভালো মন্দের প্রতি তার কোনো চিন্তা থাকে না বরং এ সময় সাধকের আত্মকেন্দ্রিকতা ধ্বংস হয়ে যায়। সাধক এই সময় আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ফানা প্রাপ্ত হওয়ার পর সাধকের কোনো নিজস্ব ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য থাকে না। এই সময় একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া সাধক আর কিছুই চান না। আল্লাহর অসীম ইচ্ছাতেই সাধকের সামান্য ইচ্ছা পূরণ হয়। এইভাবে আত্মার পাশবিক প্রবৃত্তি ও মানবিক গুণাবলি ধ্বংস হলে তা আল্লাহ্ সম্মিলনের উপযুক্ত হয় । এই ফানা সম্পর্কে হযরতে রাসূলে কারীম
(স.) বলেন, “মৃত্যু কাবলা আনতা মৃত্যু” অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্বেই মৃত্যুবরণ কর। নিজ. অস্তিত্ববোধকে অসীম অস্তিত্বের মাঝে হারানোর মধ্যেই সাধক এসময় প্রেম মদিরা পান করে। এই ফানা লাভ করতে সাধককে ৪টি সোপান পার হতে হয়। যথা-
১. কানা ফিল ওজুদ, ২. ফানা ফিনশায়েখ, ৩. ফানা ফির-রসূল ও ৪. ফানা ফিল্লাহ্। হিন্দু দর্শনের সমাধি লাভ ও বৌদ্ধদের নির্বাণ লাভ ফানার স্তরে ঘটে থাকে। ফানার এই স্তরসমূহ কোনো সাধক পাড়ি দিতে পারলেই তিনি আল্লাহ্র বন্ধু বা ওলী আল্লাহ্ হয়ে যান।
২. বাকা: বাকা হচ্ছে সুফি মূলনীতিগুলোর মধ্যে শেষ স্তর। অর্থাৎ ফানার শেষ আর বাকার শুরু। আল্লাহর সাথে সম্মিলন অর্জনের সদর্থক দিকটি হলো বাকা। বাকার অর্থ আল্লাহর স্বরূপে, গুণে প্রতিষ্ঠা লাভ। একজন সাধক বাকা প্রাপ্ত হলে তখন আল্লাহ্র অনুভূতি সাধকের অনুভূতি হয়ে যায়। আল্লাহর অসীম চেতনাবোধই তার মহাচৈতন্য। এসময় সাধক তার অস্তিত্ব আল্লাহর অসীম অস্তিত্বের সাথে একাত্ব ও একক অবস্থা অনুভব করেন। এ স্তরের • সাধকের স্বীয় অস্তিত্ব আল্লাহর অস্তিত্বে স্থিতি লাভ করে এবং তার সত্তা ও গুণ তখন স্বয়ং আল্লাহই হয়ে যায়। হযরত জালাল উদ্দিন রুমী (র.) এই স্থরে আরোহণ করেই বলেছিলেন, : “আমি তুমি দর্শনা হলাম, তুমি আমি হলে আমি দেহ এবং তুমি প্রাণ, এরপর যেন পরি কেউ বলতে না পারে যে, আমি একজন আর তুমি আর একজন।” এই স্তরের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “আল্লাহ্ আক আল্লাহ্ জপতে জপতে মানুষই আল্লাহময় হয়ে যায়।” মোট কথা এই স্তরে সুফি সাধক আল্লাহর চিরন্তন, শাশ্বত ও অসীম সত্তায় স্থায়ীভাবে স্থিতি লাভ করেন। সাধক এ স্তরে কুতুব, গাউস, আরিফ বিল্লাহ প্রভৃতি লবাব ও সম্মানের অধিকারী হন। সাধক এসময় = অমরত্ব লাভ করে চিরজীবী ও চিরঞ্জীব হন। এ সময় জীবন ও মৃত্যু সাধকের ইচ্ছাধীন হয়ে যায়। অর্থাৎ সাধক এস্তরে প্রকৃত পক্ষে আল্লাহময় হয়ে যান।
→ সুফিবাদে ফানা ও বাকার তাৎপর্য : সুফিবাদে ফানা ও বাকার অত্যধিক তাৎপর্য ও গুরুত্ব রয়েছে। সুফিবাদ হলো একটি ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন। পার্থিব জীবনের সুখ শান্তি ত্যাগ করে এবং আত্মাকে পবিত্র করে পরম আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ । করাই হলো সুফিবাদের মূলকথা। একজন সুফির সাধনা মূলত কতকগুলো নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এ নীতিগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ চূড়ায় যাদের অবস্থান তা হলো ফানা ও বাকা। একজন ব্যক্তি গুরু যখন ফানা লাভ করে তখন তার আপন পর, সুখ-শান্তি, সংসার, মায়া, দুনিয়ার ভালোবাসা সবকিছু থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে। জী তখন তার ভালোবাসা একমাত্র আল্লাহকে পাবার জন্যই উদগ্রীব কি
হয়ে থাকে। আর ফানার পরে বাকা লাভ করলে সে তখন নিজেকে আল্লাহর সমতুল্য মনে করে। প্রথমে সাধক ফানা লৈ
পর্যায়ে উপনীত হয় পরে বাকা পর্যায়ে। সুফিবাদে ফানা ও বাকার তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সুফিবাদের মূলনীতিগুলোর মধ্যে যেগুলো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তার মধ্যে ফানা ও বাকা অন্যতম। ফানা ও বাকা স্তরে এসে সাধক কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে পরম প্রিয় আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করে। সর্বোপরি, ফানার স্তরে এসে সাধক আল্লাহর অস্তিত্ব খুঁজে পায় এবং বাকার স্তরে এসে সে আল্লাহর পরম প্রিয় বন্ধু বা আল্লাহময় হয়ে যায়।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%9a%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%b8%e0%a7%81%e0%a6%b2%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%bf-%e0%a6%86/