উত্তর ৷ ভূমিকা : মহামতি প্লেটো ছিলেন গ্রিক পণ্ডিতপ্রবর দার্শনিক সক্রেটিসের শিষ্য । প্লেটোর চিন্তাধারা ছিল বৈপ্লবিক । তাঁর গ্রন্থসমূহ চিন্তাক্ষেত্রে আলোড়ন সৃষ্টি করে । তাঁর ‘ দি রিপাবলিক ’ দি লজ ’ ও ‘ দি স্টেটম্যান ‘ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । প্লেটোর মতে আদর্শ রাষ্ট্রের লক্ষ্য উত্তম জীবন । তিনি বিশ্বাস করতেন দার্শনিক রাজাই ( Philosopher king ) আদর্শ রাষ্ট্রের কর্ণধার ।
আদর্শ রাষ্ট্রের শাসকগণের দার্শনিক রাজার গুণাবলি অর্জন : প্লেটোর কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্র ন্যায়ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল । তাঁর মতে , জ্ঞান ছাড়া প্রকৃত ন্যায়ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব ।
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো দার্শনিক রাজার শাসন । প্লেটো যে রাষ্ট্রের চিত্র অঙ্কন করেছেন তা গতানুগতিক বা আধুনিক রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী । তিনি তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের শাসনভার দার্শনিক শ্রেণীর হাতে অর্পণ করেছেন । এ দার্শনিক শ্রেণী সক্রেটিসের ‘ Virtue is knowledge ‘ এই গুণে গুণান্বিত [ T তারা সৎ ও মহৎ । তারা ন্যায় বা পুণ্য কি , তা বুঝেন । একমাত্র দার্শনিকেরাই জনগণের মনস্তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারেন । প্রশাসনের পক্ষে এটি অপরিহার্য । জনগণের মনের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে না পারলে শাসনকার্য পরিচলনা করা সম্ভব নয় । দার্শনিক রাজার আদর্শে জনগণ অনুপ্রাণিত হবে । রাষ্ট্রের লক্ষ্যই হলো সৎ ও আদর্শ নাগরিক গড়ে তোলা এবং এটা দার্শনিক রাজার পক্ষেই সম্ভব ।
প্লেটো দার্শনিক রাজার দায়িত্ব সম্পর্কে বলেন , দার্শনিক রাজা শাসনভার তুলে নেয়ার পূর্বে আদর্শ রাষ্ট্রের একটি রূপরেখা অঙ্কন করে নিবেন । আর এরূপ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কেবল স্বর্গেই বিদ্যমান । তিনি লক্ষ্য রাখবেন যেন রাষ্ট্রের মধ্যে দারিদ্র্য ও প্রাচুর্য পাশাপাশি অবস্থান না করে । রাষ্ট্রের আয়তন একেবারে ছোট আবার খুব বড়ও হবে না । দার্শনিক রাজা শিক্ষা ব্যবস্থার উপর জোর দিবেন ।
সমালোচনা : প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে সমস্ত গুণাবলি সম্পন্ন দার্শনিক রাজার সন্ধান করেছেন তা বাস্তবে পাওয়া অসম্ভব । দার্শনিক রাজার শাসনকে আইনের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া হয়েছে । কিন্তু আইনবিহীন শাসন স্বৈরাচারের নামান্তর ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় , প্লেটো তাঁর শিক্ষা গুরু সক্রেটিসের ‘ Vritue is knowledge ‘ নীতিকে বাস্তবে রূপদান করতে গিয়ে আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য একজন আদর্শ দার্শনিক রাজার সন্ধান করেছেন । বাস্তবে তিনি এ শাসকের সন্ধান পান নি বা পরবর্তীকালেও এরূপ শাসকের দর্শন লাভ সম্ভব হয় নি । তবে J. P. Suda বলেন , “ দার্শনিক রাজার শাসন তত্ত্বের হাজারো ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এটি সত্য যে , প্লেটোর সকল মৌলিক দর্শনের মধ্যে দার্শনিক রাজার শাসন সর্বাপেক্ষা মৌলিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ।
প্রশ্নঃ প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণাকে তুমি কি কাল্পনিক মনে কর ?
উত্তর ৷ ভূমিকা : মহান রাষ্ট্রদার্শনিক প্লেটো ছিলেন রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম দিকপাল । প্লেটোর হাত দিয়েই রাষ্ট্রচিন্তা সর্বপ্রথম একটি সমন্বিত বিষয় হিসেবে রূপ লাভ করে । প্লেটো রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খল এবং রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি তার আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখা অঙ্কন করেন । প্লেটোর আদর্শরাষ্ট্র ছিল একটি কাল্পনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা । আমি প্লেটোর রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কাল্পনিক বলে মনে করি । নিম্নে তার কারণগুলো উল্লেখ করা হলো :
কাল্পনিক হিসেবে প্লেটোর আদর্শরাষ্ট্র : নিম্নে কাল্পনিক হিসেবে প্লেটোর আদর্শরাষ্ট্রের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো : ১. বাস্তবায়ন সম্ভব নয় : প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র বাস্তবে রূপায়ণ অসম্ভব । তার দার্শনিক রাজার সন্ধান পাওয়া একটি অবাস্তব কল্পনা । ফলে প্লেটোর আদর্শরাষ্ট্র কল্পনাজগতের ভ্রমণকারী বলে গণ্য হয় ।
২. অভিজাততান্ত্রিক : প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তিনি অভিজাতদের পক্ষপাতিত্ব করেছেন । তিনি তার আদর্শ রাষ্ট্রে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের কোন সুযোগ রাখেন নি । ফলে আদর্শ রাষ্ট্র ছিল একটি কল্পিত রূপরেখা ।
৩. ন্যায়ধর্ম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা : প্লেটোর আদর্শরাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে ন্যায়ধর্ম । কিন্তু তিনি তার আদর্শরাষ্ট্রে ন্যায়বিচারের নামে শ্রেণীভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন । এখানে তিনি বিশেষ শ্রেণীর সুযোগসুবিধা প্রদান করেন ।
৪. আইনের শাসন : প্লেটোর আদর্শরাষ্ট্রে আইনের শাসনকে অস্বীকার করে ব্যক্তির শাসনের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন । আইনের শাসনকে অস্বীকার করে ব্যক্তির স্বৈরাচারী শাসনকে সমর্থন করেন , ফলে এটি একটি অবাস্তব রাষ্ট্রের রূপরেখা ।
৫. সাম্যবাদ : প্লেটো আদর্শরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি যে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন তা অভিনব এবং কাল্পনিক । পরিবার প্রথা উচ্ছেদ এবং সম্পত্তির মালিকানা শাসকশ্রেণীর জন্য না রাখা একটি কাল্পনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে , প্লেটোর আদর্শরাষ্ট্রের মডেলটি ছিল একটি অবাস্তব কল্পনা । তিনি ছিলেন ভাববাদী দার্শনিক । তার আদর্শ রাষ্ট্র ছিল একটি নিছক রোমাঞ্চ । তার আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখা ছিল একটি সমসাময়িক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকল্পে একটি ধারণা কাঠামো । বাস্তবে এ রাষ্ট্রব্যবস্থা বাস্তবায়ন সম্ভব নয় । ফলে তার আদর্শরাষ্ট্র ছিল একটি • কাল্পনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার রূপরেখা ।
প্রশ্ন প্লেটোর বর্ণিত শিক্ষাব্যবস্থার স্তরসমূহ আলোচনা কর ।
অথবা , প্লেটোর শিক্ষা ব্যবস্থার ধরন আলোচনা কর ।
অথবা , প্লেটোর শিক্ষা ব্যবস্থা কাঠামো বর্ণনা কর ।
অথবা , প্লেটোর শিক্ষা ব্যবস্থা স্তর বিন্যাস কর ।
উত্তর ৷ ভূমিকা : প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থা একটি সামাজিক প্রক্রিয়া , যার দ্বারা একটি সমাজের ইউনিটসমূহ সামাজিক চেতনা ও প্রেরণায় ভরপুর করে তোলে এবং সামাজিক চাহিদাগুলো পরিপূর্ণ করে । এটি এমন একটি মাধ্যম যার দ্বারা ব্যক্তি অতি সহজেই সমাজে নিজেকে খাপখাইয়ে নিতে পারে এবং নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যেতে প্রেরণা লাভ করে । প্লেটো ন্যায়ভিত্তিক আদর্শ রাষ্ট্রের বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন । প্লেটোর কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্রের মূলভিত্তি ছিল শিক্ষাব্যবস্থা । প্লেটোর মতে , “ ভালো শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে যে কোন উন্নতি সম্ভবপর । কাজেই শিক্ষাকে যদি অবহেলা করা হয় তবে রাষ্ট্র অন্য যা কিছুই করুক তাতে কিছুই আসে যায় না ।
প্লেটো বর্ণিত শিক্ষাব্যবস্থার স্তর : প্লেটো শিক্ষাব্যবস্থাকে দুটি প্রধান স্তরে বিভক্ত করেছেন । যথা :
১. প্রাথমিক শিক্ষা ও
২ . উচ্চতর শিক্ষা ।
১. প্রাথমিক শিক্ষা : প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার লক্ষ্য হবে শিশুর অন্তরে মহৎ ভাবমূর্তি সৃষ্টি করা । প্লেটোর মতে , প্রাথমিক শিক্ষার বয়ঃসীমা হবে শৈশব থেকে ২০ বছর পর্যন্ত । প্রাথমিক শিক্ষার উপাদান দুটি । যথা :
ক . সংগীতমূলক শিক্ষা : প্লেটো সংগীতমূলক শিক্ষার মাধ্যমে আত্মা এবং মনের ইন্ধন যুগিয়েছেন । তিনি সংগীতমূলক শিক্ষার দ্বারা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ অবদান কবিতা , গান , গঠনমূলক শিল্প ইত্যাদির বিশদ ব্যাখ্যা ও গবেষণা করেছেন । এগুলো চর্চার মধ্য দিয়ে শিশুরা প্রাথমিক জ্ঞান অর্জনের সুযোগ লাভ করবে ।
খ . ব্যায়ামমূলক শিক্ষা : এ পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থায় অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীগণ শারীরিক ব্যায়াম বা দেহচর্চার মধ্য দিয়ে নিয়মানুবর্তিতা ও আত্মসংযম আয়ত্ত করতে শিখবে এবং তৎসঙ্গে মানবোচিত গুণাবলির উৎকর্ষ সাধন করতে শিখবে ।
২. উচ্চতর শিক্ষা : প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থায় উচ্চতর শিক্ষা তিনটি স্তরে বিভক্ত । যথা :
ক . ২০ থেকে ৩০ বছর : এ সময় গভীরভাবে গণিত , জ্যামিতি , সংগীত ও জ্যোতিশাস্ত্র শিক্ষা করতে হবে । শিক্ষা শেষে একটি বাছাই পরীক্ষার মাধ্যমে উচ্চতর শিক্ষার দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য শিক্ষার্থী নির্বাচিত করা হবে ।
খ . ৩০ থেকে ৩৫ বছর : এ পর্যায়ে উচ্চ দর্শনের জ্ঞান অর্জন অন্তর্ভুক্ত থাকবে । এর আগে উচ্চতর দর্শন শিক্ষা দেয়া হবে না । কেননা পরিণত বয়স ছাড়া উচ্চতর দর্শন গ্রহণ একটু জটিল হয়ে যায় ।
গ . ৩৫ থেকে ৫০ বছর : এ পর্যায়ে বাস্তব কর্মসাধনার কৌশল শিক্ষা দেয়া হবে । এ সময়ের শিক্ষার্থীগণ রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করবে । এ বয়সে শিক্ষার্থীদের উপর রাষ্ট্রের দায়িত্ব অর্পণ করা হলে সুশাসন পাওয়া সম্ভব হবে ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে , প্লেটো তৎকালীন সমাজব্যবস্থার উপর নির্ভর করে তাঁর শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন । তাই তাঁর তত্ত্বে কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি থাকতেই পারে । তবুও তাঁর প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থা যে একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা এবং ‘ রিপাবলিক ’ গ্রন্থ যে শিক্ষার উপর লিখিত উত্তম গ্রন্থ এটি বেশিরভাগ দার্শনিকই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন ।