অথবা , প্লেটোর রচিত , ” The Republic ‘ গ্রন্থের সারবস্তু আলোচনা কর ।
অথবা , প্লেটোর ‘ The Republic ‘ গ্রন্থে বর্ণিত দর্শন মূল্যায়ন কর ।
উত্তর ৷৷ ভুমিকা : সমগ্র রিপাবলিক রচনাটি দশটি পুস্তকে বিভক্ত । এ দশটি পুস্তকে প্লেটো কোন নীতি বা তত্ত্বের উপর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেন নি , বরং তা শিক্ষা , শিল্প , দর্শন , রাষ্ট্রতত্ত্ব , সমাজতত্ত্ব , সাহিত্য , সংস্কৃতি , ন্যায়তত্ত্ব , নৈতিকতা অর্থনীতি জোতির্বিদ্যা প্রভৃতি সকল বিবেকের জ্ঞানভাণ্ডারের পরিপূর্ণ বিশ্লেষণ হচ্ছে রিপাবলিক । মূলত উত্তম জীবন ও উত্তম মানুষকে নিয়েই দি রিপাবলিকের মূল আলোচনা । প্লেটোর কথায় এর অর্থ হচ্ছে , “ উত্তম রাষ্ট্রে মানুষের জীবন এবং তা অর্জনের উপায় নির্দেশ করা ।
দি রিপাবলিক : নিম্নে প্লেটোর রিপাবলিকের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো :
১. আদর্শ রাষ্ট্র : প্লেটোর ‘ The Republic ‘ এর মূল লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও সংহতি । এ রাষ্ট্রীয় সংহতি বজায় রাখার জন্য তিনি এক আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনা করেন । এখানে তিনি গোটা সমাজকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন । যথা : ক . দার্শনিক ; খ . যোদ্ধা ও গ . উৎপাদক শ্রেণী । এ তিন শ্রেণীর লোক রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করবে । এখানে কেউ নিজের খেয়ালখুশিমতো কাজ করবে না । রাষ্ট্র নির্দেশিত পথে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে । আদর্শ রাষ্ট্র অভিজাত শ্রেণীর স্বার্থে সৃষ্ট । এজন্য বলা হয় , ” Everything for the state , nothing beyond the state ; nothing above the state .
২. দার্শনিক রাজার শাসন : প্লেটোর দার্শনিক রাজার শাসনতত্ত্ব প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে অদ্যাবধি বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছে । তাঁর এ বক্তব্যের জন্য তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে কল্পনাবিলাসী হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছেন । যাহোক , প্লেটোর যুক্তি হচ্ছে যেহেতু শাসক সর্বোচ্চ জ্ঞানের অধিকারী , তাই কোন আইনের বাধা তার কার্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না । শাসক নিজের প্রজ্ঞা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন । সেজন্য প্লেটোর দার্শনিক রাজার শাসনকে স্বৈরাচারী বলে আখ্যায়িত করা হয় ।
৩. ‘ দুই সত্য ‘ তত্ত্ব : প্লেটোর ‘ রিপাবলিক ‘ গ্রন্থে আলোচিত বিষয়ের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো তাঁর ‘ দুই সত্য ‘ বা ‘ দুই জগৎ ‘ তত্ত্বের । একটি জগৎ হলো পরিদৃশ্যমান নিত্যকার জগৎ । অন্যটি হলো এ দৃশ্যমান জগতের উৎস , যা চিরন্তন , অদৃশ্য ও অপরিবর্তনীয় । প্লেটো মনে করেন , “ এ অপার্থিব অদৃশ্য জগৎই চরম সত্য ।
৪. ন্যায়বিচার : প্লেটোর ‘ The Republic ‘ গ্রন্থের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বা প্রধান আলোচ্যবিষয় হলো ন্যায়বিচার ( Justice ) । ন্যায়বিচার সম্পর্কিত প্লেটোর বক্তব্য রিপাবলিকের কোন বিশেষ একটি অংশে কেন্দ্রীভূত নয় । ‘ রিপাবলিক ‘ গ্রন্থটির সামগ্রিক আলোচনার মধ্য থেকেই ন্যায়ের ধারণাটি তৈরি করা যেতে পারে । প্লেটোর কাছে ‘ ন্যায় ’ দয়া , মহত্ত্ব , সাহস কিংবা জ্ঞান নয় । এগুলো হলো রাষ্ট্র বা ব্যক্তির বিশেষ গুণাবলি । প্লেটো বলেছেন , “ ন্যায়কে বৃহৎ আকারে প্রত্যক্ষ করার লক্ষ্যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে । ” অর্থাৎ ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য রাষ্ট্রে ‘ ন্যায় ‘ আবিষ্কৃত হয়েছে । তাঁর মতে , যা কিছু সর্বোত্তম রাষ্ট্রের অনুকূলে তাই ন্যায়বিচার ।
৫. শিক্ষাব্যবস্থা : প্লেটো তাঁর ‘ রিপাবলিক ‘ গ্রন্থে শিক্ষানীতি বা শিক্ষাব্যবস্থার উপর ব্যাপক আলোচনা করেছেন । প্লেটোর মতে , “ শিক্ষার মাধ্যমেই নাগরিকদের প্রকৃতি প্রদত্ত গুণাবলির উন্মেষ ও বিকাশ সাধিত হবে । ” শাসকগণ শিক্ষাপ্রাপ্ত হলে আইন , শাসন ও বিচারের বিষয়ে কোন চিন্তার কারণ থাকবে না । তিনি বলেছেন , উত্তম শিক্ষা লাভকারী শাসক অধর্মের কাজ করতে পারে না । সুতরাং দর্শন ছাড়া দার্শনিক শাসক তৈরি হতে পারে না ।
৬. সাম্যবাদ : শাসক শ্রেণীর সাম্যবাদ সম্পর্কে প্লেটো তাঁর ‘ রিপাবলিক ‘ গ্রন্থে আলোচনা করেছেন । শাসক শ্রেণীর সাম্যবাদ বিষয়টিকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব বলা যায় । রাষ্ট্রের শাসন সংক্রান্ত দায়িত্ব নির্বিঘ্নে পালন করার লক্ষ্য নিয়ে প্লেটো অভিভাবক শ্রেণীর অর্থাৎ শাসক ও সেনাবাহিনীর জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পরিবার ব্যবস্থার বিলুপ্তির প্রস্তাব করেছেন । রাষ্ট্রের ঐক্যের জন্য এবং শাসক ও সেনাবাহিনী , অর্থাৎ অভিভাবক শ্রেণী যাতে নিঃস্বার্থভাবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে পারে , সেজন্য অভিভাবকদের ব্যক্তিগত পরিবার ও সম্পত্তি থাকতে পারবে না । অভিভাবক শ্রেণীর জন্য প্লেটোর এ প্রস্তাবই ‘ প্লেটোর সাম্যবাদ ‘ নামে অভিহিত ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে , প্লেটোর ‘ Republic ‘ নীতিমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কিত একটি একক গ্রন্থ । এখানে মানুষকে চিন্তা করা হয়েছে রাষ্ট্রের সভ্য হিসেবে , আর রাষ্ট্রকে চিন্তা করা হয়েছে একটি নৈতিক সংগঠন হিসেবে । ‘ রিপাবলিক ‘ মূলত বাস্তব উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত একটি গ্রন্থ ; ‘ Republic ‘ মনের দর্শন । তবে তা কেবল মনকে বিশ্লেষণ করার জন্য নয় মানুষকে সতর্ক করা ও পরামর্শ দেয়ার জন্যও । এ গ্রন্থে প্লেটো মানুষের মুক্তির জন্য সত্যকে অনুসন্ধান করেছেন । সুতরাং প্লেটো সম্পর্কে জ্ঞান লাভের আবশ্যকতা বর্তমান যুগেও রয়েছে একথা বলা যায় ।