অথবা, প্রশ্নমালা প্রণয়নে পদবিন্যাস কর। প্রশ্নমালা রচনায় যে উদ্ভাবনা সমস্যা হয় তার
একটি চিত্র তুলে ধর।
অথবা, প্রশ্নমালা প্রণয়নের পদক্ষেপসমূহ বিশ্লেষণ কর। প্রশ্নমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে যেসব
সমস্যার জন্ম হতে পারে তার চিত্র তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা : প্রশ্নমালা পদ্ধতিতে সমাজ গবেষণার তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে বর্তমানকালে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত একটি মাধ্যম। এখানে উত্তরদাতার নিকট ডাকযোগে বা অন্য কোন মাধ্যমে প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়। উক্ত প্রশ্ন ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে উত্তর প্রদান করেন। ফলে তথ্য নিরপেক্ষ ও সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
প্রশ্নমালা প্রণয়নের পদক্ষেপসমূহ : প্রশ্নমালা বলতে কতকগুলো শব্দ ব্যবহার করে উত্তরদাতার নিকট থেকে উত্তর সংগ্রেহের জন্য যে প্রশ্ন প্রণয়ন করা হয় তাকে বুঝায় । উপযুক্ত শব্দ প্রশ্নমালার ব্যবহারের মাধ্যমে সঠিক ও কাঙ্ক্ষিত উত্তর সংগ্রহ করা হয় । প্রশ্নমালা প্রণয়নে কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় । যথা :
১. পর্যাপ্তভাবে নির্দিষ্ট প্রশ্নাবলি : গবেষণার তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রশ্নমালা প্রণয়ন একটি পদ্ধতির নাম । প্রশ্নমালা প্রণয়নে সতর্ক থাকতে হয়, যেমন প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনা না করতে পারে। তাছাড়া প্রশ্নে স্পষ্টতা ও সহজবোধ্যতা থাকতে হবে। প্রশ্নমালার মাধ্যমেই কোনো বিষয়ে জিজ্ঞাসু প্রশ্নগুলো সংগ্রহ করা হয়। তাই প্রশ্নগুলো হতে হবে কোনো নির্দিষ্ট বিষয় সংশ্লিষ্ট। প্রশ্নের পরিমাপ খুব বেশি হবে না। তবে প্রশ্নমালা পর্যাপ্ত হতে হবে, যেমন প্রাসঙ্গিক বিষয়সমূহ এড়িয়ে না যায় । পর্যাপ্তভাবে নির্দিষ্টসংখ্যক প্রশ্ন প্রণয়ন করে প্রশ্নমালাকে আরও উপজীব্য করে তোলা যায় ।
২. সহজবোধ্য ভাষা ব্যবহার : সহজ ভাষা সহজেই বুঝা যায় এবং সহজ ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে অপরকে সহজে বুঝানো হয় । তাই প্রশ্নমালা প্রণয়নে ভাষা সহজ সবল ও প্রাঞ্জল হতে হবে। এমন প্রশ্ন প্রণয়ন করতে হবে, যা চট করে একজন বুঝে ফেলতে পারে। প্রশ্নের ভাষা এমন হওয়া উচিত নয় যে, উত্তরদাতার বুঝতে সমস্যার সম্মুখীন হবে। তাই সহজবোধ্য প্রশ্নমালা প্রণয়ন করে উত্তরদাতার নিকট থেকেই সহজেই কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব।
৩. প্রশ্নের দ্ব্যর্থবোধকতা দূর করা : প্রশ্নমালাকে আরো উপজীব্য করে গড়ে তোলার জন্য প্রশ্নমালার দ্ব্যর্থবোধকতা দূর করতে হবে । এমন প্রশ্ন করতে হবে যেটা শুধু একটি বিষয়কে নির্দেশ করতে পারে। কোন প্রশ্নের সাথে একাধিক বিষয় জড়িত থাকে । এ ধরনের দ্ব্যর্থবোধক প্রশ্ন পরিহার করতে হবে।
৪. দোনালা প্রশ্ন পরিহার : দোনালা প্রশ্ন বলতে বুঝায় একই সাথে একই প্রশ্নের দুটি বিষয় উপস্থিত থাকা । যেমন প্রশ্ন হতে পারে আপনি কি দরিদ্র ও মহিলাদের অধিকার রক্ষায় ভূমিকা পালন করেন? এ ধরনের প্রশ্নে একই সাথে দরিদ্র ও মহিলাদের বিষয় প্রশ্ন করা হয়েছে। উত্তরদাতা দরিদ্রদের সম্পর্কে না মহিলাদের সম্পর্কে উত্তর দেবেন এরূপ দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়তে পারেন। এজন্য দোনালা প্রশ্ন পরিহার করতে হবে।
৫. অস্পষ্ট শব্দাবলি পরিহার : কোনো বিষয়ে গবেষণার জন্য চাই সঠিক নির্দেশনাও সঠিক উত্তর । প্রশ্ন যদি অস্পষ্ট থাকে, তাহলে উত্তরও অস্পষ্ট হতে পারে। উত্তর অস্পষ্ট হলে গবেষণার ফলাফলও অস্পষ্ট হবে। তাই অস্পষ্ট শব্দাবলি প্রশ্নমালা থেকে পরিহার করতে হবে।
৬. অগ্রবর্তী প্রশ্ন : অগ্রবর্তী প্রশ্নের ভালো এবং মন্দ উভয় দিক রয়েছে। কোনো কাঙ্ক্ষিত উত্তর সংগ্রহের জন্য গবেষকরা নিজেদের মেধা খাটিয়ে এ ধরনের প্রশ্ন করেন। এতে পক্ষপাতিত্বের সুযোগ থেকে যায় । অগ্রবর্তী প্রশ্নের ধরন বুদ্ধিমান উত্তরদাতারা বুঝতে পেরে উত্তরকে ভিন্ন দিকে ধাবিত করতে পারে ।<
br>৭. অনুকল্পিত প্রশ্ন : এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর উত্তরদাতাকে নির্দিষ্ট বিষয়ের ভবিষ্যৎ কল্পনা করে উত্তর প্রদান করতে হয়। কোনো বিষয়ে নিশ্চিত আগাম পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব না হলেও মোটামুটি ধারণা করা যায়। সম্পূর্ণ ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত উত্তর সবসময় গবেষণার জন্য সফল হয় না।
৮. অযাচিত প্রশ্ন : উত্তরদাতা যে ধরনের ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট নয় তাকে সে বিষয়ে প্রশ্ন করাকে অযাচিত প্রশ্ন বলে । যেমন-একজন ব্যক্তি পেশায় শিক্ষক । তাকে প্রশ্ন করা হলো- আপনি কৃষি থেকে মাসে কত আয় করেন? এরূপ অযাচিত প্রশ্ন উত্তরদাতাকে বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে । তাই অযাচিত প্রশ্ন প্রণয়ন করা থেকে বিরত থাকতে হবে । দর্শ’ প্রকাশনী লিমিটেড
৯. ব্যক্তিগত প্রশ্ন : গবেষক গবেষণা সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন করেন। তবে তিনি উত্তরদাতার সাথে অন্তরঙ্গতার মাত্রা হিসেবে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারেন। ব্যক্তিগত প্রশ্নের মাধ্যমে গবেষক সম্যক বিষয়ে আরো বেশি অবহিত হতে পারেন। এজন্য গবেষক প্রয়োজনবোধে ব্যক্তিগত প্রশ্নের মাত্রা বৃদ্ধি করে দিতে পারেন।
১০. নাজুক প্রশ্ন : এমন কিছু প্রশ্ন আছে, যা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা ব্যক্তিস্বার্থকে আঘাত হানতে পারে। এ ধরনের প্রশ্নকে নাজুক প্রশ্ন বলে। উত্তরদাতা সচেতন হলে এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর নাও দিতে পারেন। এমনকি উত্তরদাতা প্রশ্নকারীর উপর ক্ষেপে গিয়ে চড়াও হতে পারেন। তাই প্রশ্নমালা প্রণয়নে নাজুক অবস্থায় ফেলতে পারে এরূপ প্রশ্ন পরিহার করতে হবে।
১১. সময়সাপেক্ষ আচরণ সম্পর্কিত প্রশ্ন : কিছু কিছু বিষয় কোন তথ্য প্রদানে বেশি সময় গ্রহণ করে । কোনো ব্যক্তি নিয়মিত এ ধরনের বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারেন। আবার অনিয়মিত সম্পৃক্ততাও এখানে থাকতে পারে। যেমন- ক্রিকেট খেলা একটা সময় সাপেক্ষ বিষয়। কোনো ব্যক্তি নিয়মিত টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখতেও পারে, আবার নাওপারে । টিভিতে ক্রিকেট খেলা না দেখেও পত্রপত্রিকার মাধ্যমে খেলার খবর জানা যায়। তাই উত্তরদাতার নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রশ্নমালা প্রণয়ন করতে হবে।
প্রশ্নমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সমস্যা : প্রশ্নমালা প্রণয়ন একটি জটিল বিষয়। প্রশ্নমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার উদ্ভব হতে পারে সেগুলো নিম্নরূপ :
১. নমনীয়তার অভাব : প্রশ্নমালা পদ্ধতি তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে খুবই অনমনীয়। এতে নির্দিষ্টসংখ্যক প্রশ্ন থাকে এবং ব্রও নির্দিষ্ট থাকে । উত্তরদাতাকে বেশিরভাগ প্রশ্ন নির্দিষ্ট উত্তর থেকেই উত্তর দিতে হয়। গবেষক প্রশ্ন বা উত্তর পরিবর্তন করতে পারেন না ।
২. উত্তরদানের হার কম : প্রশ্নমালা পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট প্রশ্ন থাকে এবং উত্তর নির্দিষ্ট থাকে (অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে থাকে না) । ফলে উত্তরদাতাকে নির্দিষ্ট উত্তরের মধ্য থেকেই একটি উত্তর দিতে হয়, যা তার পছন্দ না হতে পারে । ফলে প্রশ্নমালা পদ্ধতিতে উত্তরদাতা উত্তরদানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বেশিরভাগ উত্তর প্রশ্নমালা পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়ে উঠে না ।
৩. সময়সাপেক্ষ : প্রশ্নমালা প্রণয়ন করা, উত্তরদাতা সংগ্রহ, উত্তর সংগ্রহ সময় সাপেক্ষ বিষয়। কোন বিষষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য অনেকগুলো প্রশ্ন প্রণয়ন করা হয়। এগুলোর প্রতিটি উত্তর সংগ্রহের জন্য অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়। এর ফলে উত্তরদাতাতো বটেই প্রশ্নকারীও বিরক্ত হতে পারেন ।
৪. ব্যয়বহুল : প্রশ্নমালা প্রণয়ন বেশ ব্যয়বহুল। গবেষণার ব্যয় বৃদ্ধির ফলে গবেষণার কাজে গতিশীলতা নাও আসতে পারে।
৫. পক্ষপাতমূলক নমুনা : কোনো বিষয়ে শিক্ষিত ব্যক্তি ছাড়াও অশিক্ষিত ব্যক্তি তথ্য সরবরাহ করতে পারেন। প্রশ্নমালা প্রণয়ন করা হলে অশিক্ষিত ব্যক্তি কোন তথ্য দিতে পারে না। অথচ এমনও পর্যায় আ
ছে যেখানে কোন বিষয়ে শিক্ষিত ব্যক্তির তুলনায় অশিক্ষিত ব্যক্তি সঠিক ও যুক্তিপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করতে পারে ।
৬. ব্যাখ্যার অনুপস্থিতি : প্রশ্নমালায় নির্দিষ্টসংখ্যক প্রশ্ন প্রণয়ন করা হয়। প্রশ্নমালায় শুধু প্রশ্ন স্থান পায়। কোন প্রশ্নটি প্রণয়ন করা হলো সে বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রশ্নমালার স্থান পায় না। ফলে সঠিক ব্যাখ্যার অভাবে তথ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে ।
৭. কাঠামোগত প্রশ্ন : প্রশ্নমালার প্রশ্নগুলো নির্দিষ্ট কাঠামো সূত্রে আবদ্ধ। এটা অনেকটা অপরিবর্তনীয় । এর উত্তরগুলোও কাঠামো প্রক্রিয়ার নির্দিষ্ট । উত্তরগুলোর পরিবর্তনশীলতার বিষয়টিও অপরিবর্তনীয় । নির্দিষ্ট কাঠামো ঘরে বসে প্রণয়ন করা হয়, যা বাস্তব ক্ষেত্রে কার্যকর নাও হতে পারে ।
৮. অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশ : গবেষক প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহের জন্য যে কোনো মানুষকে যে কোনো মুহূর্তে চিহ্নিত করতে পারে । এক্ষেত্রে গবেষক পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করে না। ফলে উত্তর সংগ্রহ প্রক্রিয়া স্বাভাবিকতা হারাতে পারে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানবজাতির উন্নয়নের ক্ষেত্রে সামাজিক গবেষণা মাধ্যম হিসেবে কাজ করে । তথ্য সংগ্রহের অন্যতম প্রধান এবং বতর্মানকালে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে প্রশ্নপত্র পদ্ধতি স্বীকৃত । তাই এখানে প্রশ্নকর্তাকে অত্যন্ত সতর্ক ও সচেতনতার সাথে কাজ করতে হবে ।