অথবা , রুশোকে কী একজন সর্বাত্মকবাদী হিসেবে অভিহিত করা যথার্থ হবে ? ব্যাখ্যা কর ।
অথবা , রুশো ছিলেন একজন সর্বাত্মকবাদী দার্শনিক বর্ণনা কর । অথবা , রুশোকে কেন সর্বাত্মকবাদী দার্শনিক বলা হয় ?
উত্তর ৷ ভূমিকা : জ্যা জ্যাক রুশোর রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রীয় ধারণা যে ” সাধারণ ইচ্ছাতত্ত্ব ” তা গণসার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে আখ্যায়িত হলেও তার প্রকৃতি বিষয়ে মতামতের ঐক্য নেই । কেউ তাঁর ” General will ” কে সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রের ” Will of the Nation ” এর সাথে মিলিয়ে দেখেছেন আবার কেউ কেউ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ” Public opinion ” এর সাথে সমার্থক বিবেচনা করেছেন । তাই অনেকের নিকট রুশো সর্বাত্মকবাদী আবার অনেকের নিকট রুশো গণতন্ত্রী । বার্ট্রান্ড রাসেল রুশোকে হিটলারের স্রষ্টা বলে অভিহিত করেছেন । প্রকৃতপক্ষে সর্বাত্মকবাদে স্বেচ্ছাচারী একনায়ক নিজের ইচ্ছাকে যেভাবে “ জনগণের ইচ্ছা ” বলে প্রচার করে না , রুশোর দর্শন সে শিক্ষা এবং সুযোগ কোনটিই দেয় না । তাই রুশোকে সর্বাত্মকবাদী বলা যুক্তিযুক্ত নয় ।
রুশোকে সর্বাত্মকবাদী বলা যথার্থ কি না : অনেক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ রুশোকে সর্বাত্মকবাদী দার্শনিক হিসেবে অভিহিত করেছেন । রুশোকে সর্বাত্মকবাদী বলা যথার্থ কি না তা নিম্নে আলোচিত হলো :
১. ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রসঙ্গে : রুশো ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ সুনিশ্চিত করেছিলেন । মানুষকে স্বাধীন হতে বাধ্য করে রুশো ব্যক্তিস্বাধীনতাকেই লঙ্ঘন করেছেন । যা সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রনায়কদের অমোঘ অস্ত্রে পরিণত হয়েছে । এদিক থেকে রুশোকে সর্বাত্মকবাদী বলে আখ্যায়িত করা যথার্থ হবে ।
২. ব্যক্তিস্বার্থ বিরোধী : ব্যক্তিস্বার্থ বিরোধী হিসেবে রুশোকে সর্বাত্মকবাদী বলে অভিহিত করা যায় । রুশোর চিন্তাধারায় সামগ্রিক সমাজের স্বার্থ প্রতিফলিত হওয়ায় তা সমাজতন্ত্রকেই সমর্থন করেছে । সমাজতন্ত্র ব্যক্তিকে প্রাধান্য না দিয়ে রাষ্ট্রকেই প্রাধান্য দেয় , যা সর্বাত্মক ব্যবস্থার নামান্তর ।
৩. রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা : রুশোর মতে , সার্বভৌমত্ব সাধারণ ইচ্ছার উপর ন্যস্ত । সাধারণ ইচ্ছাকে চরম ক্ষমতাসম্পন্ন করে তিনি সর্বাত্মকবাদের পরিচয় দিয়েছেন । রুশোর মতে , রাষ্ট্রই চূড়ান্ত সার্বভৌম ক্ষমতার আধার । রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তি “ অসীম , চরম , চূড়ান্ত , হস্তান্তর অযোগ্য , অবিভাজ্য , অবিনশ্বর , প্রতিনিধিত্ববিহীন ” এসবই সর্বাত্মকবাদের পরিচয় বহন করে ।
৪. সাধারণ ইচ্ছা প্রসঙ্গে : রুশোকে সর্বাত্মকবাদী প্রমাণ করার জন্য তার সাধারণ ইচ্ছাতত্ত্বই যথেষ্ট । রুশোর সাধারণ ইচ্ছা ও সকলের ইচ্ছার মধ্যে পার্থক্য বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে । আবার একে তিনি চিরস্থায়ী ও হস্তান্তর অযোগ্য ঘোষণা করেছেন । বস্তুত এসব কারণেই একনায়কগণ তাদের ক্ষমতা ও কার্যক্রমকে বৈধ করার জন্য রুশোর সাধারণ ইচ্ছাকে তাদের নিজেদের মতো ব্যবহার করেছেন ।
৫. সামাজিক ধর্ম : রুশো সামাজিক ধর্মতত্ত্ব মতে , এক অভিনব ধর্মতত্ত্ব রচনা করে । এ নতুন ধর্ম মানুষের ধর্মমতে আঘাত হেনেছে এবং এ ধর্ম প্রতিটি ব্যক্তিকে মানতে বাধ্য করায় তিনি সর্বাত্মকবাদের পরিচয় দিয়েছেন । তাছাড়া রুশোর সামাজিক ধর্ম সকল ধর্ম অনুশীলনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে , যা সর্বাত্মকবাদের বহিঃপ্রকাশ ।
৬. রাষ্ট্রই সর্বেসর্বা : রুশোর রাষ্ট্রদর্শন হলো জনগণ বিনাশর্তে তাদের সমস্ত ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে যৌথ ব্যক্তিত্ব বা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে সমর্পণ করেছে , যা সর্বাত্মক প্রকৃতির ।
৭. রাষ্ট্রের বিরোধিতা করা যাবে না : রুশো বলেছেন , রাষ্ট্র কোন অন্যায় করতে পারে না । রাষ্ট্র ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করলেও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছুই করার নেই । কেননা রাষ্ট্র সর্বক্ষমতা সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান । এটি সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য ।
৮. সরকার প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে : রুশো বলেছেন , “ সরকার কোন চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি হয় নি । বরং তা সার্বভৌম শাসকের আদেশের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে । ” তার এ মন্তব্য স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর । যার জন্য তাকে সর্বাত্মকবাদী বলে আখ্যায়িত করা যায় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে , অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ দার্শনিক রুশোর রাষ্ট্রদর্শন আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে এক ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে । তার সাধারণ ইচ্ছাতত্ত্ব আপাতদৃষ্টিতে সর্বাত্মকবাদী মতবাদ হিসেবে গণ্য হতে পারে । কিন্তু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তার মতবাদ নৈতিকতা বিবর্জিত নয় । এছাড়া সামাজিক ধর্ম নিয়ে তাকে সর্বাত্মকবাদী বলা হলেও প্রকৃত অর্থে তিনি একজন জাতীয় চেতনা সৃষ্টিকারী ধর্মের দিশারি ছিলেন । সুতরাং সকল দিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা বলতে পারি , রুশোকে একজন সর্বাত্মকবাদী দার্শনিক বলে অভিহিত করা যুক্তিসঙ্গত হবে না ।