প্রশ্নঃ বাংলাদেশে স্বল্প মাথাপিছু আয়ের কারণগুলো বর্ণনা কর ।
উত্তর ৷ ভূমিকা : বাংলাদেশে স্বল্প মাথাপিছু আয় বিরাজমান । পৃথিবীর নিম্ন মাথা পিছু আয়ের দেশের মধ্যে অন্যতম একটি দেশ বাংলাদেশ । বাংলাদেশ বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর অন্যতম । এদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় অত্যন্ত কম । ফলে তাদের জীবনযাত্রার মানও খুবই নিচু । নিম্নে বাংলাদেশের জনগণের স্বল্প মাথাপিছু আয়ের কারণসমূহ বর্ণনা করা হলো :
১. অনুন্নত কৃষি : বাংলাদেশে এখনো মান্ধাতার আমলের চাষাবাদ পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে । আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগেও আমাদের দেশের কৃষকরা লাঙল – জোয়ালের সাহায্যে চাষাবাদ করে । যান্ত্রিক চাষাবাদ পদ্ধতি ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার খুবই কম । ফলে আমাদের কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনের পরিমাণ অত্যন্ত কম ।
২. শিক্ষার অভাব : বাংলাদেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ সম্পূর্ণ নিরক্ষর । অশিক্ষা ও অজ্ঞতার কারণে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা কম । ফলে তাদের আয়ও কম ।
৩. সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব : সুষ্ঠু ও বাস্তব পরিকল্পনার অভাবে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি খুবই মন্থর । অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে আমাদের বিগত পাঁচশালা পরিকল্পনাগুলোর সাফল্য রীতিমতো হতাশাব্যঞ্জক ।
৪. প্রাকৃতিক সম্পদের অপূর্ণ ব্যবহার : বাংলাদেশে প্রাকৃতিক সম্পদ যথাযথ ব্যবহার এখনো সম্ভবপর হয় নি । মূলধন , দক্ষ জনশক্তি ও প্রযুক্তিবিদ্যার অভাব আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদসমূহের পরিপূর্ণ ব্যবহারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে । ফলে বাংলাদেশ এখনো বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর অন্যতম ।
৫. বেকার সমস্যা : বাংলাদেশ বেকার সমস্যায় জর্জরিত । ব্রিটিশ আমলে এদেশে কোন উল্লেখযোগ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে নি । পাকিস্তানি আমলে সামান্য কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে বটে । তবে চাহিদার তুলনায় সেগুলো কম ।
৬. জনসংখ্যার চাপ : বাংলাদেশে জনসংখ্যা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে । ২০০৯-১০ সালের প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯৯০ জন লোক বাস করে । বর্তমানে জনসংখ্যা বছরে শতকরা প্রায় ১.৩২ ভাগ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে । ফলে জনগণের আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না ।
৭. মূলধনের অভাব : বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় কম ফলে জনগণের সঞ্চয়ের ক্ষমতাও অত্যন্ত কম । ফলে আমাদের দেশে মূলধন সৃষ্টির হার স্বল্প । মূলধনের অভাবে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনশক্তিকে কাজে লাগানো সম্ভব হয় না ।
৮. খনিজ সম্পদের অপ্রতুলতা : কয়লা , তেল , লৌহ প্রভৃতি খনিজ সম্পদ আমাদের নেই । অর্থনৈতিক উন্নয়নে এগুলোর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । প্রয়োজনীয় খনিজ সম্পদের অভাব আমাদের উন্নয়নের পথে বাধার সৃষ্টি করেছে ।
৯. কারিগরি জ্ঞানের অভাব : স্বল্প আয় , জীবনযাত্রার নিম্নমান ও দেশে কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্রের অভাবে বাংলাদেশের শ্রমিকের কারিগরি জ্ঞান অত্যন্ত কম । কুশলী শ্রমিকের অভাবে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি মন্থর এবং মাথাপিছু আয়ও কম ।
১০. দক্ষ উদ্যোক্তার অভাব : বাংলাদেশে দক্ষ উদ্যোক্তা শ্রেণীর একান্ত অভাব রয়েছে । মূলধন ও দক্ষ উদ্যোক্তা শ্রেণীর অভাবে আমাদের শিল্পোন্নয়নে গতি অত্যন্ত মন্থর ।
১১. প্রাকৃতিক বিপর্যয় : আমাদের দারিদ্র্যের পিছনে প্রকৃতির ভূমিকাও কম নয় । বাংলাদেশ মূল । কৃষিপ্রধান দেশ এবং আমাদের কৃষি প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল । কিন্তু বন্যা , খরা , ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি কারণে প্রতিবছর আমাদের বিপুল পরিমাণ শস্যের ক্ষতি হয় ।
১২. শিল্পের অনুন্নতি : আমাদের দেশ শিল্পে অনগ্রসর । ব্রিটিশ আমলে এদেশে শিল্পোন্নতি হয় নি । পাকিস্তানি আমলেও এদেশে শিল্পোন্নয়নের গতি ছিল মন্থর । স্বাধীনতার পর অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে । শিল্পের অভাবে আমাদের কাঁচামালগুলো কম দামে বিদেশে বিক্রি করে দিতে হয় । শিল্পের অভাব বাংলাদেশে জনগণের স্বল্প মাথাপিছু আয়ের অন্যতম কারণ ।
১৩. অনুন্নত অর্থনৈতিক কাঠামো : অনুন্নত সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোও আমাদের স্বল্প মাথাপিছু আয়ের অন্যতম কারণ । আমাদের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো উন্নত হয় নি । বাংলাদেশ সড়ক ও রেলপথ প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম । অনুন্নত যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত অবস্থা দূর না করতে পারলে আমাদের মাথাপিছু আয় কখনই বৃদ্ধি পাবে না ।