অথবা , আধুনিক রাষ্ট্রমতবাদে মন্টেস্কুর গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর ।
অথবা , আধুনিক রাষ্ট্রদর্শনে মন্টেক্ষুর মূল্যায়ন কর ।
উত্তর ভূমিকা : আধুনিক যুগের অন্যতম রাষ্ট্রদার্শনিক মন্টেস্ক ১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের উপকণ্ঠে লা – ব্রিডি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর মেধা ছিল অসাধারণ । আর জ্ঞানার্জনের স্পৃহা ছিল প্রবল । স্টোয়িকবাদের উপর ছিল তাঁর প্রচণ্ড দুর্বলতা । তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থগুলোর মধ্যে পার্সিয়ান লেটার্স , কনসিডারেশন অন দি কজেস অব দ্যা গ্রেটনেস , ডিক্লাইন অব দ্যা রোম ও দি স্পিরিট অব লজ অন্যতম । তবে তাঁর Spirit of Laws তাঁকে সর্বাধিক খ্যাতির আসনে বসিয়েছে ।
রাষ্ট্রদর্শনে মন্টেক্ষুর অবদান : মন্টেস্কুর রাষ্ট্রদর্শনে নানাপ্রকার অবদান রয়েছে । নিম্নে তাঁর রাষ্ট্রদর্শনের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো আলোচনা করা হলো :
১. আইন সংক্রান্ত ধারণা : মন্টেস্কু পূর্ববর্তী লেখকগণ আইনকে হয় যুক্তিসঙ্গত বিধান কিংবা সার্বভৌমের আদেশ হিসেবে গণ্য করেছেন । কিন্তু এগুলোর কোনটিতেই আইনকে তাঁর যথার্থ কার্যকারণ সম্পর্কের সাধারণ নীতির উপর প্রতিষ্ঠা করা হয় নি । এদিক থেকে ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কুই প্রথম ব্যক্তি যিনি আইনকে কার্যকারণ নীতির উপর ভিত্তি করে আইনের সংজ্ঞা দিয়েছেন ।
২. আইনের সংজ্ঞা : The Spirit of Laws ‘ গ্রন্থে তিনি বলেছেন , ‘ সাধারণভাবে বলতে গেলে আইন যে কোন জিনিসের প্রকৃতির ফলে উদ্ভূত স্বাভাবিক সম্পর্কের ফল । ” জড়বাদী জগৎ যেমন কতকগুলো সুনির্দিষ্ট আইনের দ্বারা পরিচালিত হয় এবং কোথাও আইনের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না , মনুষ্য সমাজও তেমনি আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত । হঠকারিতা বা খামখেয়ালির স্থান কোথাও নেই । সধারণভাবে আইন হচ্ছে মানুষের যুক্তিবাদিতা । তিনি আইনকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ বলে স্বীকার করেন নি । মানুষের আচরণের নিয়মগুলোই হলো আইন । মানুষ সমাজবদ্ধ জীব বলে নিজেদের মধ্যে নানাভাবে সম্পর্কযুক্ত । তাই যেখানেই সম্পর্ক সেখানেই আইন । আইন সম্পর্ককে পরিচালিত করে ।
৩. আইনের সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা : তিনি বলেছেন , সমাজের সর্বত্র আইন এক নয় । কারণ সমাজের গঠন , মানুষের প্রকৃতি এবং আচরণ সর্বত্র এক নয় । এ বিভিন্নতাই আইনের বৈচিত্র্যের অন্যতম কারণ । মন্টেস্কু বলেছেন , বিভিন্ন জড়বাদী পরিবেশ আইনের মূলনীতি স্থির করে । এটিই তাঁর আইনের সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা হিসেবে মনে করা হয় । ৪. আইনের প্রকারভেদ : মন্টেস্কু তিন প্রকার আইনের কথা বলেছেন । যথা :
ক . আন্তর্জাতিক আইন : বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক এ আইন দ্বারা স্থির হয় ।
খ . রাজনৈতিক আইন : একটা বিশেষ সমাজের শাসক ও শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক এ আইন দ্বারা স্থিরীকৃত হয় ।
গ. পৌর আইন : এ আইন দ্বারা নাগরিকরা পরিচালিত হয় ।
৫. স্বাধীনতা সম্পর্কে মন্টেস্কুর ধারণা : মন্টেস্কু ছিলেন স্বাধীনতার একনিষ্ঠ ভক্ত । তিনি স্বাধীনতার প্রকৃতি বিশ্লেষণ শুরু করেছেন রাজনীতির স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্যে পার্থক্য টেনে , আইনের বিধান অনুযায়ী কাজ করাকে তিনি স্বাধীনতা বলেছেন । তাঁর মতে , ব্যক্তিগত স্বাধীনতার জন্য সংবিধানের প্রয়োজন নেই । তবে রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য সংবিধানের প্রয়োজন রয়েছে ।
৬. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ : তিনি মানুষের স্বাধীনতা , এর নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের জন্য সরকারি ক্ষমতাকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন । এ তিনটি বিভাগ হলো – আইন বিভাগ , শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ । আইন বিভাগের কাজ আইন প্রণয়ন করা , শাসন বিভাগের কাজ কূটনীতিক ও সামরিক কার্যাদিসহ অভ্যন্তরীণ কাজকর্ম পরিচালনা করা ও বিচার বিভাগের দায়িত্ব হলো অপরাধীর শাস্তি বিধান ও বিরোধের মীমাংসা করা । ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসারে প্রতিটি কাজের দায়িত্ব থাকবে ভিন্ন বিভাগের উপর ।
৭. সরকারের শ্রেণীবিভাগ : তিনি সরকারকে প্রধানত তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন । যথা : প্রজাতন্ত্র , রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র । কিন্তু প্রজাতন্ত্রকে আবার তিনি গণতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্র এ দু’ভাগে ভাগ করেছেন । তিনি প্রকৃতি ও নীতির উপর ভিত্তি করে সরকারের শ্রেণীবিভাগ করেছেন । তাঁর সরকারের শ্রেণীবিভাগের ধরন
ক . প্রজাতন্ত্র : এ ব্যবস্থায় সরকারের সার্বভৌম ক্ষমতা জনসাধারণের হাতে ন্যস্ত থাকে ।
খ . রাজতন্ত্র : এ ব্যবস্থায় সার্বভৌম ক্ষমতা মাত্র একজনের হাতে ন্যস্ত থাকে ।
গ . স্বৈরতন্ত্র : এ ব্যবস্থায়ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী থাকে একজন । তবে তিনি তা নির্ধারিত আইনের অনুসারী হয়ে প্রয়োগ করেন না , বরং তিনি এটা প্রয়োগ করেন নিজের খেয়ালখুশিমতো ।
৮. আমেরিকার সংবিধান ও মন্টেস্কু : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের রচয়িতারা মন্টেস্কুর ক্ষমতা বিভাজন নীতির দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন । মন্টেস্কুকে অনুসরণ করে তাঁরা ক্ষমতা বিভাজন নীতিকে সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত করেছেন ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে , মন্টেস্কুর দর্শনের হয়ত কিছুটা সীমাবদ্ধতা ছিল । তাই অষ্টাদশ শতাব্দীর রাষ্ট্রচিন্তাকে তিনি নিজের পক্ষে আনতে পারেন নি । কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে , তার রাষ্ট্রচিন্তা আধুনিকতার আলোয় উদ্ভাসিত । বিশেষ করে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পাথেয় হিসেবে কাজ করে । সম্ভবত এজন্যই বার্কি বলেছেন যে , “ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মন্টেস্কুর বিশেষ নীতি হলো ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি ।
প্রশ্ন ২০ স্বাধীনতা সম্পর্কে মন্টেক্ষুর ধারণা আলোচনা কর ।
অথবা , আইন ও স্বাধীনতা সম্পর্কে মন্টেস্কুর বক্তব্য বিশ্লেষণ কর । অথবা , আইন ও স্বাধীনতা সম্পর্কে মন্টেক্ষুর মতবাদ ব্যাখ্যা কর ।
উত্তর ভূমিকা : ফরাসি জ্ঞানালোকের যুগে ( Age of Enlightenment ) যে সকল দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটেছিল তাদের মধ্যে রুশোর পরেই মন্টেস্কুর স্থান । মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এ দার্শনিক স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কযুক্ত বিষয়াদি নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন । তিনি তাঁর The Spirit of the Laws গ্রন্থে স্বাধীনতা সম্পর্কে বলেন , রাষ্ট্র ও ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্ক যখন ব্যক্তিকে নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করার অধিকার দেয় তখনই স্বাধীনতার সূচনা হয় । অর্থাৎ শুধু অধিকারই যথেষ্ট নয় , নিরাপত্তার সাথে সে অধিকার চর্চা করার সুযোগ ও সুবিধাই হলো স্বাধীনতা । তিনি মনে করতেন , স্বাধীনতার দুটি অপরিহার্য শর্ত হলো আইন ও ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ । আইন স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয় আর ক্ষমতা স্বতন্ত্রকরণ অন্যের হস্তক্ষেপ নিবারণ করে । এভাবেই স্বাধীনতা রক্ষিত হয় । ইতিহাসে মন্টেস্কু এমতামতের জন্য সর্বজনের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন ।
স্বাধীনতা সম্পর্কে মন্টেস্কুর ধারণা : স্বাধীনতা সংক্রান্ত তত্ত্ব প্রচার করে তিনি আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন । মন্টেস্কুর মতে , ব্যাপক অর্থে মানুষ যখন বিশ্বাস করে যে নিজের ইচ্ছামতো কাজ করার অধিকার রয়েছে , তখন তার স্বাধীনতা আছে বলে ধরে নেয়া হয় । কিন্তু তিনি বলেছেন আইনের বিধান অনুযায়ী কাজ করাকে স্বাধীনতা বলে । তিনি ইংল্যান্ডের জনগণের স্বাধীনতা দেখে মাতৃভূমির জনগণের স্বাধীনতা রক্ষার প্রতি মনোযোগী হন ।
স্বাধীনতার শ্রেণীবিভাগ : মন্টেস্কু স্বাধীনতাকে দু’ভাগে ভাগ করেন । যথা :
১. রাজনৈতিক স্বাধীনতা : মন্টেস্কু মনে করেন যে , রাজনৈতিক স্বাধীনতা সংবিধান থেকে আসে । আইন অনুযায়ী যা করার অধিকার আছে এবং যখন সে নিরাপত্তার সাথে তা সম্পন্ন করতে পারে তখন সে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করে । প্রকৃত আইন জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতা সংরক্ষণ করতে সাহায্য করে ।
২. ব্যক্তিগত স্বাধীনতা : মানুষের সাথে মানুষের যে সম্পর্ক বিরাজ করে তা থেকেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতার জন্ম হয় । এটি দাসপ্রথার বিরোধী । ব্যক্তিগত স্বাধীনতার জন্য সংবিধানের কোন প্রয়োজন নেই । ব্যক্তির আচার আচরণ ইত্যাদির উপর ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নির্ভর করে । একমাত্র সংবিধানের মাধ্যমেই জাতীয় আইন প্রণয়ন করা সম্ভব ।
সমালোচনা : মন্টেস্কু প্রদত্ত আইন ও স্বাধীনতার ধারণা বিভিন্নভাবে সমালোচনার সম্মুখীন হয় । আবার অনেকে তাঁর পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন । সেবাইন বলেছেন , “ মন্টেস্কুর আইনের সংজ্ঞার মধ্যে অস্পষ্টতা বিদ্যমান এবং এ অস্পষ্টতা দূর করার জন্য তিনি কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি । ” অন্যদিকে , স্বাধীনতা সম্পর্কে বলা হয় , তিনি ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি অধিক গুরুত্ব প্রদান করেন । তবে মন্টেস্কুর আইন ও স্বাধীনতা সম্পর্কে দেয়া মতবাদ বর্তমানে আধুনিক রাষ্ট্রে প্রতিফলন দেখা যায় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে , মন্টেস্কু তাঁর “ The Spirit of Laws ‘ গ্রন্থে আইন ও স্বাধীনতা সম্পর্কে যে ধারণা দিয়ে গেছেন তা আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে অন্যতম স্থান দখল করে আছে । Dunning বলেছেন , আইন ও স্বাধীনতা সম্পর্কে মন্টেস্কুর ধারণা কতখানি ত্রুটিহীন সে ষয়ে না গিয়ে একথা বলা চলে যে , তিনি আইনকে স্বৈরচারিতা ও খামখেয়ালির হাত থেকে মুক্ত করতে পেরেছেন । এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় ধরনের কৃতিত্ব ।