অথবা , আধুনিককালে প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থার উপযোগিতা সম্পর্কে পর্যালোচনা কর ।
অথবা , আধুনিককালে প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থার গ্রহণ যোগ্যতার মাত্রা কতখানী বিশ্লেষণ কর ।
উত্তর ৷ ভূমিকা : প্লেটোর দৃষ্টিতে ” The one great thing ” হিসেবে বিবেচিত শিক্ষা ব্যবস্থা আজো সভ্যতা অর্জন , সংরক্ষণ ও পরিবর্ধনের একমাত্র মাধ্যম । কিন্তু প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে সুপারিশকৃত শিক্ষার উপাদানগুলো আজকের প্রেক্ষাপটে কিছুটা বিসদৃশ মনে হয় । তার পর ও তার শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যার আবদান আজো বিদ্যমান । নিম্নে প্লেটোর শিক্ষা ব্যবস্থার প্রযোজ্যতা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
আধুনিককালে প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থার প্রযোজ্যতা : কিন্তু তা আধুনিককালে রাষ্ট্রসমূহে সম্পূর্ণ প্রযোজ্য না হলেও আংশিকভাবে প্রযোজ্য । যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে । যেখানে সম্পূর্ণভাবে শিক্ষার প্রসার ঘটেছে । বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় তার শিক্ষাব্যবস্থা কতখানি প্রযোজ্য তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ও সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা : প্লেটো শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ব্যক্তির ইচ্ছাধীনে পরিচালিত হতে দিতে চান নি । তিনি মনে করতেন , রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার মাধ্যমে নাগরিকদেরকে রাষ্ট্রের উপযুক্ত সেবক হিসেবে গড়ে তোলা । তাই আর্নেস্ট বার্কার বলেছেন , Plato prescrised for a state controled system of compulsory education . ” আধুনিক কালেও এ বক্তব্য সত্য বলে প্রতীয়মান হয় । ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ প্রাথমিক শিক্ষাকে সকল রাষ্ট্রের জন্য সর্বজনীন , অবৈজ্ঞানিক ও রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে । বাংলাদেশও এ ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছে ।
২. সংগীত ও শরীর চর্চার অন্তর্ভুক্তি : প্লেটো শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে সংগীত , ব্যায়াম ও শরীর চর্চার বিষয়কে প্রাথমিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে , যা আধুনিক যুগেও প্রায় প্রতিটি স্কুলে পরিলক্ষিত হয় এবং এটা রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ।
৩. নারী ও পুরুষের সমশিক্ষা : তিনি পুরুষদের মতো নারীদেরও শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন , যা বর্তমানকালে স্বীকৃতি লাভ করেছে ।
৪. উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দর্শন , অধিবিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্তি : তাঁর প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থায় জ্যোতিষবিদ্যা , দর্শন প্রভৃতি পাঠ্য বিষয়ের সাথে বর্তমান বিশ্ব একাত্মতা ঘোষণা করেছে ।
৫. কল্পনা সাহিত্য অধ্যায়নে নিয়ন্ত্রণ আরোপ : প্লেটো মনে করতেন যে শিশুদের শিক্ষা কারিকুলাম নির্ধারণে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন । কারণ যেসব কল্পনা বিলাসী সাহিত্য শিশু মনে ভীতি সঞ্চার করে , ঈশ্বরের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি করে , প্রতারণা শিক্ষা দেয় , বীরযোদ্ধাদের প্রতি অসম্মান করতে শিক্ষা দেয় , জাতীয় চরিত্রগুলোকে প্রশংসা করতে শেখায় না সেগুলো পরিত্যাগ করা উচিত । আদর্শ জীবন গঠনের জন্য নীতিবোধ ও নৈতিকতার উৎকর্ষের দিকটিতে প্লেটো অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন ।
উপযুক্ত শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না । শিক্ষাই জ্ঞান সংযোজনের একমাত্র পন্থা । প্লেটোর এ ধারণা আজও যথাযথ মর্যাদার সাথে স্বীকৃত ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে , প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থা যতই সমালোচনার সম্মুখীন হোক না কেন তৎকালীন গ্রিসের সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবং আজকের যুগের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে তাঁর শিক্ষাব্যবস্থা প্রশংসার দাবিদার । তিনি রাষ্ট্র থেকে অশিক্ষা ও স্বার্থান্ধতা চিরতরে দূর করতে চেয়েছিলেন । তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন , মানুষের মন প্রথমে ব্যাধিমুক্ত করা প্রয়োজন । এজন্য আদর্শ শিক্ষানীতিকেই ব্যাধি জর্জরিত মানব মনের ঔষধরূপে ব্যবহার করতে হবে বলে তিনি মনে করেন । তাঁর শিক্ষাব্যবস্থা রাষ্ট্র ও সমাজের কল্যাণের নিয়ামক রূপে পরিগণিত হয় । একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে , মানুষের আত্মিক উন্নয়নে প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থা উৎকর্ষতার মুকুট । প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থা মানবজীবনের ভ্রান্ত পথকে সংশোধন করে উত্তম , সুসংহত এবং বলিষ্ঠ জীবনের দিকনির্দেশনা করে । তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম । এজন্য বর্তমান সময়ের সাথে তার শিক্ষা ব্যবস্থার যথেষ্ট সামঞ্জস্যতা রয়েছে ।
প্রশ্নঃ প্লেটোর দৃষ্টিতে শিক্ষার গুরুত্ব বলতে কী বুঝ ? আলোচনা কর ।
অথবা , প্লেটোর দৃষ্টিতে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে পর্যালোচনা কর । অথবা , প্লেটোর দৃষ্টিতে শিক্ষার গুরুত্ব মূল্যায়ন কর ।
উত্তর ৷ ভূমিকা : ‘ শিক্ষার সাথে সম্পর্কহীন জীবন অন্ধ ‘ এ মহান সত্যটি বর্তমান যুগের মানুষ যেমন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে , তেমনি আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন । তাঁর কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্রের মূলভিত্তি ছিল শিক্ষাব্যবস্থা । প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্র গঠন করতে গিয়ে সাম্যবাদের উপর যত বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন শিক্ষাব্যবস্থার উপর ।
প্লেটোর দৃষ্টিতে শিক্ষার গুরুত্ব : প্লেটোর ‘ রিপাবলিক ‘ গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে একটি আদর্শ রাষ্ট্র । আর এ আদর্শ রাষ্ট্রের অভিভাবকদের উপযুক্তরূপে গড়ে তোলার জন্যই তিনি শিক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন । প্লেটোর দর্শনের মূল কথা হলো “ পুণ্যই জ্ঞান আর শিক্ষাই পুণ্য অর্জনের একমাত্র মাধ্যম । সুতরাং জ্ঞান অর্জনের জন্য সঠিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা একান্ত আবশ্যক । প্লেটো মনে করেছেন , “ একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই আদর্শ রাষ্ট্রের সংহতি আনয়ন করা সম্ভব । ” তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা ।
এ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সাম্যবাদ অপেক্ষা শিক্ষার উপর অধিক পরিমাণে নির্ভর করেছেন । শুধু প্লেটোর ধারণাতেই নয় , বরং সামগ্রিকভাবে গ্রিকদের ধারণায়ও শিক্ষাকে একটি সামাজিক প্রক্রিয়া বলে বিবেচনা করা হয়েছে । প্লেটো তাঁর শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে দার্শনিক রাজাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন । মানবজীবন সম্পর্কে উন্নততর দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার নিমিত্তে শিক্ষাকেই তিনি একমাত্র মাধ্যম বলে মনে করেন ।
মানব আত্মার পূর্ণ বিকাশ সাধনের জন্য এবং রাষ্ট্রের নৈতিক জীবনে নাগরিকদের পদার্পণের উদ্দেশ্যে প্লেটো শিক্ষাকেই একমাত্র অন্যতম উপায় বলে বর্ণনা করেন । দেহ এবং খাদ্যের সম্পর্ক যেমন অবিচ্ছেদ্য , তেমনি তিনি মনে করেন আত্মা ও শিক্ষার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য । দেহের মতোই আত্মা সক্রিয় থাকার জন্য খাদ্য না পেলে সে বেঁচে থাকতে পারে না । তাই আত্মা যতক্ষণ বেঁচে থাকবে , ততক্ষণ তার উপযুক্ত খাদ্যের জন্য শিক্ষা প্রয়োজন । আর এসব দিক বিবেচনায় প্লেটো শিক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে , প্লেটো তৎকালীন সমাজব্যবস্থার উপর নির্ভর করে তাঁর শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন । তাই তাঁর তত্ত্বে কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি থাকতেই পারে । তবুও তাঁর প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থা যে একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা এবং ‘ রিপাবলিক ‘ গ্রন্থ যে শিক্ষার উপর লিখিত উত্তম গ্রন্থ এটি বেশিরভাগ দার্শনিকই সমর্থন করেছেন ।