অথবা, জৈন দার্শনিকগণ কর্তৃক প্রমাণ সম্পর্কে চার্বাক মতবাদের সমালোচনাগুলো উল্লেখ কর।
অথবা, জৈনরা কীভাবে চার্বাকদের প্রমাণ সম্পর্কিত মতবাদের সমালোচনা করেন?
উত্তর৷ ভূমিকা : জৈন দর্শন অতি প্রাচীন। এর আবির্ভাব হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগে। চব্বিশজন তীর্থঙ্কর জৈন দর্শনের প্রচারক। জৈন দার্শনিকগণ সাধারণত প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দকে প্রমাণরূপে স্বীকার করেন। কিন্তু চার্বাক দার্শনিকদের মতে, একমাত্র প্রত্যক্ষই যথার্থ প্রমাণ। অনুমান এবং শব্দ প্রমাণ নয়। চার্বাকদের এই মত জৈনরা মেনে নেন নি। চার্বাক মতবাদের অসারতা প্রমাণ করার জন্য জৈনরা নিম্নলিখিত যুক্তি উপস্থাপন করেন।
প্রথমত, জৈনগণ বলেন, যে যুক্তির সাহায্যে চার্বাকরা অনুমান এবং শব্দকে প্রমাণরূপে গ্রহণ করা যায় না বলেছেন সেই একই যুক্তির সাহায্যে প্রত্যক্ষকেও প্রমাণরূপে গ্রহণ করা যায় না। চার্বাকগণের মতে, অনুমান ও শব্দ কোন কোন সময় ভুল প্রমাণিত হয় এবং মানুষকে প্রতারিত করে। তাই এগুলোকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। কিন্তু প্রত্যক্ষ জ্ঞানও কোন কোন সময় ভুল প্রমাণিত হয় এবং মানুষকে প্রতারিত করে। যেমন- অন্ধকারে দড়িকে সাপ বলে প্রত্যক্ষ করা।
দ্বিতীয়ত, অনুমানকে প্রমাণরূপে গ্রহণ করার পক্ষে চার্বাকদের আর এক আপত্তি এই যে, অনুমানলব্ধ জ্ঞান পরোক্ষ ও অস্পষ্ট তাই অযথার্থ । কিন্তু জৈনগণ বলেন, প্রত্যক্ষ জ্ঞানও পরোক্ষ। কেননা এটা ইন্দ্রিয়নির্ভর। পরোক্ষ জ্ঞান যদি অযথার্থ হয়, তবে প্রত্যক্ষ জ্ঞানও অনুমানের মত অযথার্থ হতে বাধ্য।
তৃতীয়ত, কোন কোন ক্ষেত্রে অনুমান ও শব্দ জ্ঞান ভুল হয়েছে দেখে চার্বাকগণ সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে, সর্বক্ষেত্রে অনুমান ও শব্দজ্ঞান ভুল হবে। জৈনরা বলেন, চার্বাকগণের এই সিদ্ধান্ত অনুমানের সাহায্যে পাওয়া। অনুমানলব্ধ জ্ঞান যদি ভুল হয় তবে তাদের এ সিদ্ধান্তটিও ভুল ।
চতুর্থত, চার্বাকগণ অনুমানের উপর নির্ভর করে ঈশ্বর, আত্মা ও পরলোকের সত্তা অস্বীকার করেন। এ ব্যাপারে তাদের যুক্তি বা অনুমান নিম্নরূপ :
যাহা প্রত্যক্ষগোচর নয়, তার সত্তা নাই ঈশ্বর, আত্মা ও পরলোক প্রত্যক্ষগোচর নয় ঈশ্বর, আত্মা ও পরলোকের সত্তা নাই।
চার্বাকদের এ ধরনের যুক্তিকে জৈনরা হাস্যকর ও ছেলেমানুষী বলে প্রত্যাখ্যান করেন।
পঞ্চমত, ‘প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ’ চার্বাকদের এই সিদ্ধান্তও অনুমাননির্ভর। কতিপয় ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষকে নির্ভুল পেয়ে তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, সবক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ নির্ভুল হবে এবং এই সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে তারা বলেন, প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। কিন্তু তাদের অনুমাননির্ভর এ ধারণা দৃষ্টান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মিথ্যা প্রমাণ হতে বাধ্য
বলে জৈনরা মনে করেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে দেখা যায় যে, চার্বাকগণ প্রায় ক্ষেত্রে প্রতি পদক্ষেপে অনুমানের সাহায্যে গ্রহণ করেছেন। নিজেরা যেখানে অনুমানের সাহায্য নিয়েছেন সেখানে তারা অনুমানকে প্রমাণরূপে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানানোয় জৈন দার্শনিকরা তাদের মতবাদের সমালোচনা করেন। সুতরাং এ কথা বলা যায় যে, চার্বাকগণ অনুমানের বিরুদ্ধে যাই বলুক না কেন, তারা অনুমানকে পরোক্ষ প্রমাণরূপে স্বীকার করে নিয়েছেন।