প্রবীণদের চাহিদাসমূহ আলোচনা কর।প্রবীণদের সমস্যাসমূহ পুরণ না হওয়ার ফলে কি কি সমস্যার সৃষ্টি হয়?

অথবা, প্রবীণদের চাহিদাসমূহ কি কি? এসব চাহিদাসমূহ পূরণ না হওয়ার ফলে কি কি সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে? আলোচনা কর।
অথবা, প্রবীণদের মৌলিক চাহিদাসমূহ কী কী? প্রবীণদের চাহিদা পূরণ না হলে কী কী সমস্যা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে?
অথবা, প্রবীণদের অনুভূত চাহিদাগুলো কী কী? চাহিদাগুলো পূরণ না হলে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তা লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানুষের জীবনের একটি স্তর হল বার্ধক্য বা প্রবীণতা।মানবজীবনের বিকাশ পর্যায়ের সর্বশেষ স্তর হিসেবে রয়েছে বার্ধক্য বা প্রবীণ। আজকের শিশু আগামী দিনের প্রবীণ। তাই অন্যান্য সম্প্রদায়ের মত প্রবীণ সম্প্রদায়কেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। অনেক সময়ই দেশ ও জাতির সংকটকালীন মুহূর্তে প্রবীণরা তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে উপযুক্ত পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়ে দেশ ও জাতিকে বিপদ থেকে উদ্ধার করে। এছাড়া আজকে যারা প্রবীণ তারা একসময় যুবক বা পৌঢ় ছিল এবং সমাজের জন্য প্রভূত কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড সম্পাদন করেছে। কিন্তু বয়সের ভারে আজ সে প্রবীণ।সমাজে প্রবীণদেরও কতকগুলো বিশেষ চাহিদা ও প্রয়োজন আছে যা তারা সমাজের কাছ থেকে প্রত্যাশা করে।
প্রবীণদের চাহিদা : নিম্নে প্রবীণদের চাহিদা সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
১. দৈহিক বা শারীরিক চাহিদা : অন্যান্য সম্প্রদায় যেমন- শিশু-কিশোর, যুবক, নারী এদের মত প্রবীণদেরও শারীরিক চাহিদা রয়েছে। তাদের এসব শারীরিক চাহিদার মধ্যে রয়েছে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘুম ইত্যাদি। বৃদ্ধরা সাধারণত বয়সের কারণে শারীরিকভাবে কর্মসম্পাদনে অনেকটা অক্ষম থাকেন। ফলে দেখা যায় আমাদের মত দেশের প্রবীণরা তাদের এসব শারীরিক প্রয়োজন যথাযথভাবে পূরণে সমর্থ হয় না। কিন্তু প্রবীণ সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ সাধনের জন্য তাদের শারীরিক চাহিদা পূরণ করা একান্ত আবশ্যক।
২. মানসিক চাহিদা : প্রবীণদের মানসিক চাহিদার মধ্যে রয়েছে তার মতামতের গ্রহণযোগ্যতা, পারিবারিক নিরাপত্তা, নিজের কাজের জন্য অন্যান্যের নিকট থেকে মর্যাদা লাভ ইত্যাদি। একজন প্রবীণ ব্যক্তি বাস্তবিক অর্থেই জীবনে বহুবিধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে থাকেন। সে চায় পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র তার এ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি দিক এবং এর যথার্থ মূল্যায়ন করুক।
৩. সামাজিক নিরাপত্তা : প্রত্যেক প্রবীণ ব্যক্তিই সামাজিক নিরাপত্তা প্রত্যাশা করেন। সামাজিক নিরাপত্তার মূলকথা হল প্রতিকূল আর্থসামাজিক অবস্থায় ব্যক্তিকে সমাজ বা রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত সাহায্য ও সহযোগিতা। প্রবীণদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি।কারণ তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। প্রবীণদের জন্য বয়স্কভাতা, পেনশন, রিলিফ, অনুদান ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা দরকার।
৪. স্বাস্থ্যসেবা : যথাযথ চিকিৎসা প্রাপ্তি প্রবীণদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ সাধারণত বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হয়। এ বয়সে বৃদ্ধদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে সহজেই বিভিন্ন ধরনের রোগজীবাণু তাদের শরীরে বাসা বাঁধে। কিন্তু যে ব্যক্তিরা তাদের জীবনের স্বর্ণালী সময়গুলো দেশ ও জাতির কল্যাণে ব্যয় করেছে, বৃদ্ধ বয়সে তাদের জন্য উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. কর্মের স্বীকৃতি : প্রবীণরা তাদের দ্বারা সম্পাদিত কর্মের স্বীকৃতি প্রত্যাশা করেন। তাদের জীবনে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে তারা যেসব ভূমিকা পালন করেছেন পরিবার তথা সমাজের সদস্যরা তাদের সেসব কর্মের স্বীকৃতি দেয়। তারা যেন প্রবীণদের অবদানকে কোনভাবে খাট বা ছোট না করেন প্রবীণরা এমনটি প্রত্যাশা করেন। তারা এরূপ স্বীকৃতি না পেলে মানসিকভাবে upset হন এবং ভেঙে পড়েন।
৬. চিত্তবিনোদন : সকল বয়সের সকল মানুষের জন্য চিত্তবিনোদন একটি উল্লেখযোগ্য এবং সর্বজনস্বীকৃত একটি চাহিদা। বৃদ্ধদের মধ্যেও রয়েছে চিত্তবিনোদনের চাহিদা। তারা,সমবয়সীদের সাথে আড্ডা ও গল্প করা, নাতি-নাতনীদের সাথে গল্প করা, বিভিন্ন ধরনের শৌখিন খেলাধুলা যেমন- লুডু, দাবা, তাস ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের চিত্তবিনোদনের প্রয়োজন মিটিয়ে থাকেন।এছাড়া মাঝে মাঝে রেডিও শোনা, টিভি ও সিনেমা দেখার মাধ্যমেও চিত্তবিনোদনের চাহিদা মিটিয়ে থাকেন।
৭. ধর্ম পালন : তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধদের মাঝে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করার প্রবণতা বেশি মাত্রায় লক্ষ্য করা যায়। ধর্মীয় চাহিদার মধ্যে রয়েছে- রোজা, নামাজ, জিকির ও তজবিহ পাঠ, পূজা-অর্চনা করা, পাদ্রী বা Father এর দায়িত্ব পালন করা, ভিক্ষা দেওয়া ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে বৃদ্ধদেরকে এসব ধর্মীয় কার্যাবলি সম্পাদনের ক্ষেত্রে পরিসর ও রাষ্ট্রের যথাযোগ্য সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করতে হবে।
৮. পেশাগত চাহিদা : বৃদ্ধদের মাঝে পেশাগত চাহিদা লক্ষ্য করা যায়। অধিকাংশ বৃদ্ধদের ক্ষেত্রেই দেখা যায় তারা অলসভাবে সময় নষ্ট করতে চান না। পূর্বের কর্মজীবনের ব্যস্ততা না থাকার কারণে তাদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মহীন সময় বা অলস সময় পড়ে থাকে। এতে তারা অনেকেই অস্বস্তি বোধ করেন। তাই প্রবীণদেরকে এজন্য শৌখিন পেশাভিত্তিক কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। যেমন- উলের কাপড় বুনন, জাল বুনন, কাপড়ে সুতার সাহায্যে নকশা অংকন ইত্যাদি।
৯. অর্থনৈতিক চাহিদা : মানুষের জীবনে অর্থের মূল্য সর্বাধিক। বলা হয়ে থাকে Money is power. তাই জন্যও অর্থের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পরিবারে তাকে শুধু শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা দিলেই চলবে না। তাকে বৃদ্ধদের
অর্থনৈতিকভাবেও নিরাপত্তা দিতে হবে। তাকে নিজের মত করে চলাফেরা করার জন্য একে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হবে।
১০. রাজনৈতিক চাহিদা : প্রবীণদের রাজনৈতিক চাহিদা হল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ, মতামত ব্যক্তকরণ, রাজনৈতিক অবস্থা দিয়ে আলাপ আলোচনা ইত্যাদি। তারা চায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের মতামতের গুরুত্ব পাক। কারণ তাদের জীবনে তারা বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির মধ্য থেকে এ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। সুতরাং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তাদের মতামতের গুরুত্ব পাক এটা তারা কামনা করে।
প্রবীণদের চাহিদা পূরণ না হওয়ার ফলে সৃষ্ট সমস্যা : প্রবীণদের চাহিদা যদি সঠিকভাবে পূরণ করা না হয় তবে কতকগুলো সমস্যা সৃষ্টি হয় সেগুলো হল :
১. দৈহিক বা শারীরিক সমস্যা : প্রবীণদের শারীরিক চাহিদা ও প্রয়োজনের অপূরণজনিত অবস্থার ফলাফল হিসেবে তাদের মাঝে শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। তারা বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি যেমন- সর্দি, কাশি, জ্বর, বাতের ব্যথা, প্রেসার,
ডায়াবেটিক ইত্যাদি বহুবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ফলে তারা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবে তাদের ওঠা বসা, চলাফেরা বিঘ্নিত হয়। সমসাময়িককালে পৃথিবীতে বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন এমন প্রবীণদের সংখ্যাই বেশি।
২. মানসিক সমস্যা : প্রবীণদের জন্য এটা একটা বিরাট সমস্যা। কারণ দেখা যায় পরিবারে প্রবীণদের সাথে অন্যান্য সদস্যরা খুব একটা সময় দিতে চায় না। এর জন্য কর্মব্যস্ততা যেমন দায়ী তেমনি রয়েছে প্রবীণদের প্রতি অবহেলাজনিত মানসিকতা। ফলে পরিবারে প্রবীণ ব্যক্তি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। সে মানসিকভাবে অনেকটা একাকীত্বে ভুগতে থাকেন। তার মধ্যে দুশ্চিন্তা, হতাশা, উদ্বিগ্নতাজনিত মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়।
৩. নিরাপত্তাহীনতা : প্রবীণ সমাজের বা শ্রেণীর চাহিদা ও প্রয়োজনের অপূরণজনিত সমস্যা হিসেবে নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পায়। কারণ সমাজে প্রবীণদের জন্য যদি উপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকে তবে তারা স্বাভাবিকভাবেই নিরাপত্তাহীনতার শিকার হন।তাদের জীবনে নেমে আসে অনিশ্চয়তা। ফলে তারা আশংকাপূর্ণ এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে সাথে নিয়ে জীবনযাপনে বাধ্য হন।
৪. কর্মহীনতা : প্রবীণদের যদি তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী কর্ম যোগাড় করে দেওয়া না যায় তবে তাদের মধ্যে কর্মহীনতাজনিত সমস্যা দেখা দেয়। যাকে আমরা প্রবীণ বেকারত্ব বলতে পারি। ফলে তারা অলসভাবে অবসর সময়গুলো পার করতে বাধ্য হয় এবং এভাবে কর্মহীন অলস জীবনযাপনের ফলে তাদের মধ্যে মৃত্যুভীতিজনিত উৎকণ্ঠা এবং স্নায়ুবিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। তারা নিজেদেরকে একটি ভারসাম্যহীন অবস্থার মধ্যে আবিষ্কার করে।
৫. নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায় : প্রবীণদের কর্ম অর্থনৈতিক ও মানসিক চাহিদা যদি পূরণ করা না হয় তবে তাদের মাঝে নির্ভরশীলতাজনিত সমস্যা বৃদ্ধি পায়। তারা সম্পূর্ণভাবে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।প্রবীণদের এ ধরনের
নির্ভরশীলতা অনেক সময়ই তাদের ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তাকে শিথিল করে দেয়।
৬. সাংস্কৃতিক সমস্যা : সাংস্কৃতিক সমস্যা প্রবীণদের জন্য মূলত নবীন প্রবীণ সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বকে নির্দেশ করে। অর্থাৎ প্রবীণদের জন্য উপযুক্ত সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ না দিলে অথবা তারা যে সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী সে সংস্কৃতি পালনে বাধা দিলে সাংস্কৃতিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। প্রবীণদের সাথে নবীনদের এ সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব যত বাড়বে সমাজকাঠামোতে ততবেশি অস্থিরতা বিরাজ করবে। সমাজ দু’টি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়বে। সমাজে প্রবীণদের অভিযোজনজনিত সমস্যা সৃষ্টি হবে।
৭. নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্ব : প্রবীণদের জন্য একটা বড় ধরনের সমস্যা হল একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা।প্রবীণরা সাধারণত সঙ্গপ্রিয় হয়ে থাকে। তারা চায় অন্যান্যের সাথে মেলামেশা করতে, তাদের সাথে নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করতে, নিজেদের জীবনে সংঘটিত দুঃসাহসিক ঘটনা শুনতে। এক্ষেত্রে যদি পরিবার ও সমাজের সদস্যরা প্রবীণদের সঙ্গ না দেয় তবে তারা মানসিকভাবে বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন।
৮. নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় : প্রবীণরা কতকগুলো মূল্যবোধ দ্বারা প্রভাবিত হন এবং নিজেরা সেগুলো মেনে চলেন। কিন্তু তাদের চাহিদা ও প্রয়োজনসমূহ যদি সঠিকভাবে পূরণ করা না হয় তবে তাদের মাঝে বিদ্যমান মূল্যবোধগুলো ভেঙে পড়ে। অনেক সময় তারা এসব মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে যান। ফলে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়। যেমন-অনেক বৃদ্ধ দেখা যায় জীবনের প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত হন।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, প্রবীণরা আমাদেরই সমাজের অংশ, আমাদেরই পূর্বসূরি।আজকের সমাজে যে নবীন সেও একদিন প্রবীণে পরিণত হবে এবং আজকের সমাজে যেসব সুযোগ সুবিধা তা আমাদের পূর্বসূরি বা প্রবীণদেরই সৃষ্টি, কিন্তু বার্ধক্যের কারণে আজ তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল। সেজন্য দরকার তাদের প্রতি তথা তাদের চাহিদা ও প্রয়োজনের প্রতি সমাজের বাড়তি মনোযোগী হওয়া। সুতরাং প্রবীণদের এসব চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণ করা একটি মানবিক, নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে আমাদের উপর বর্তায়।