অথবা, গৌতম বুদ্ধের প্রতীত্য সমুৎপাদ তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, প্রতীত্য সমুৎপাদ তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বৌদ্ধ দর্শনের প্রতীত্য সমুৎপাদ তত্ত্বটি আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের প্রবক্তা হলেন গৌতম বুদ্ধ। অন্যান্য সম্প্রদায়ের দর্শনের চেয়ে বৌদ্ধ দর্শনে কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। গৌতম বুদ্ধের দর্শন ছিল জীবনঘনিষ্ঠ। তিনি অতীন্দ্রিয় কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন নি। কারণ তা মানুষের কোন উপকারে আসে না। তাই তিনি মানব প্রকৃতি এবং এ জগতে মানুষের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর নৈতিক শিক্ষার মূলে চারটি দার্শনিক তত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। এ চারটি দার্শনিকতত্ত্বের মধ্যে প্রতীত্য সমুৎপাদ নামক মতবাদটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ : বুদ্ধদেবের শিক্ষা বা উপদেশের মধ্যে প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ প্রধান স্থান অধিকার করে আছে এবং তাঁর অন্যান্য শিক্ষা বা উপদেশ এ নীতি থেকেই অনুসিদ্ধান্ত হিসেবে নিঃসৃত হয়েছে। বুদ্ধদেবের মতে, এ সংসারে বিনা কারণে বা আকস্মিকভাবে কিছু ঘটতে পারে না। যা কিছু ঘটে তা কোন না কোন কারণের উপর নির্ভর করেই ঘটে। এ কার্যকারণ সম্বন্ধ একটা সার্বিক ও অবশ্য স্বীকার্য নিয়ম এবং বুদ্ধদেবের বিশ্বাস অনুসারে এ নিয়ম স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ জগতের মধ্যে কাজ করে চলেছে। কোন ঈশ্বর বা অতীন্দ্রিয় চেতনা সত্তা একে পরিচালনা করছে না। এ কার্যকরণ নিয়মকেই প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ (Theory of dependent origination) বলা হয়। প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ কথাটির উদ্ভব হয়েছে ‘সমুৎপাদ’ এবং ‘প্রতীত্য’ কথাটি থেকে। ‘সমুৎপাদ’ অর্থ উদ্ভব এবং ‘প্রতীত্য’ অর্থ হচ্ছে প্রাপ্ত হওয়া। সুতরাং ‘প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ’ কথাটির অর্থ কোনকিছুকে প্রাপ্ত হয়ে বা অবলম্বন করে কার্যের উদ্ভব। যা কিছু ঘটে তা কোন পূর্ববর্তী কারণের উপর নির্ভর করে ঘটে। যে কোন ঘটনা পূর্ববর্তী ঘটনা থেকেই সমুৎপন্ন হয়। যা কিছু ঘটে তা পূর্ববর্তী কোন ঘটনা দ্বারা ঘটে, আকস্মিকভাবে কোনকিছুর উদ্ভব সম্ভব নয় । বুদ্ধদেব এ মতবাদটির উপর খুবই গুরুত্বারোপ করেছেন এবং একে ধর্মরূপে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, কারণ ক্রিয়া করলে কার্যের আবির্ভাব ঘটে। কারণ ধ্বংস হলে কার্যের তিরোভাব ঘটে। এ কার্যকারণ নিয়ম বুঝতে পারাই ধর্ম। বুদ্ধের মতে, তাঁর শিক্ষার যথার্থ তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করার জন্য এ নীতিটি সর্বপ্রথম বুঝে নেয়া দরকার। প্রতীত্য সমুৎপাদবাদের উপরই অপর তিনটি দার্শনিক তত্ত্বের ভিত্তি। কর্মবাদ প্রতীত্য সমুৎপাদবাদের উপর নির্ভরশীল । কারণ অতীত কর্মের সংস্কারের ফলশ্রুতি হলো ব্যক্তির বর্তমান জীবন এবং এটাই তার ভবিষ্যৎ জীবনকে গঠিত করবে। অনিত্যবাদও প্রতীত্য সমুৎপাদবাদের উপর নির্ভরশীল। যেহেতু বস্তু তার কারণের উপর নির্ভর করে, সেহেতু বস্তু আপেক্ষিক, পরনির্ভর, শর্তাধীন এবং সীমিত। সুতরাং তারা ক্ষণিক হতে বাধ্য। অপরপক্ষে নৈরাত্ম্যবাদও প্রতীত্য সমুৎপাদবাদের উপর নির্ভরশীল। সবই যদি ক্ষণিক হয় তাহলে আত্মাও ক্ষণিক এবং আপেক্ষিক ও মিথ্যা। জড়দ্রব্যের অস্তিত্বহীনতা অর্থাৎ সংঘাতও
প্রতীত্য সমুৎপাদবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। কাজেই প্রতীত্য সমুৎপাদবাদের উপর অন্যান্য দার্শনিক তত্ত্ব নির্ভরশীল । প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ শাশ্বতবাদ এবং উচ্ছেদবাদের মধ্যবর্তী পন্থা। শাশ্বতবাদ অনুযায়ী কোন কোন বিষয় শাশ্বত অর্থাৎ অনন্ত কাল ধরে স্থায়ী । তাদের আদিও নেই, অন্তও নেই। তারা কোনকিছুর দ্বারা উৎপন্ন নয়; সেহেতু কোনকিছুর উপর নির্ভরশীল নয়। প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ নীতি অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সকলের উপর প্রযোজ্য। এর কোন আরম্ভ বা শেষ নেই। দৈহিক বা মানসিক সব রকম সংস্কৃতি ও ধর্মের ক্ষেত্রে এ নীতি প্রযোজ্য। প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি বুঝতে পারার ব্যর্থতাই সবরক
ম দুঃখের কারণ। তাছাড়া বুদ্ধদেবের চারটি আর্যসত্যও এ নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এ নীতির সাহায্যেই তিনি দুঃখের উৎপত্তির কারণ নির্দেশ করেছেন এবং দুঃখ নিরোধের উপায় নির্ণয় করেছেন। বুদ্ধদেব রোগ, জ্বরা এবং মৃত্যুর দৃশ্য দেখে উপলব্ধি করেছিলেন যে, জীবনে যে দুঃখ আছে তা একটি বাস্তব ঘটনা। দুঃখ আমাদের নিত্যসাথী, দুঃখে যেন আমাদের জীবন গড়া। জন্ম, ব্যাধি, জরা, মরণ, শোক, উৎকণ্ঠা, আকাঙ্ক্ষা, প্রিয় বিয়োগ, অপ্রিয় সংযোগ সবই দুঃখের বিষয়বস্তু। মানুষ যাকে আপাতত সুখের বিষয় মনে করে, তার মধ্যেও দুঃখের বীজ প্রচ্ছন্ন আছে। এ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বলেছেন, “জগৎ ও জীবন অনিত্য এবং যা অনিত্য তা দুঃখময়।”
সমালোচনা : প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ নানাদিক থেকে সমালোচিত হয়েছে, যা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো : বুদ্ধদেব বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জগতের দিকে তাকিয়েছিলেন। তিনি অবিদ্যা সম্পর্কে আলোচনা করেন নি। কিন্তু তত্ত্বালোচনা অপেক্ষা অবিদ্যাকে কিভাবে দূর করা যায়, এটাই ছিল তাঁর আগ্রহ। বৌদ্ধ দর্শনে নীতি আলোচনাই মুখ্য, তত্ত্বালোচনা গৌণ। কিন্তু এ কথা বলা গুরুত্বপূর্ণ যে, অবিদ্যার কারণ অনুসন্ধান করাই দার্শনিকের মুখ্য ভূমিকা হওয়া উচিত।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ বৌদ্ধ দর্শনের মূল দার্শনিক ভিত্তি। প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ থেকে বৌদ্ধ দর্শনের অন্যান্য প্রধান তত্ত্বগুলো যুক্তিসংগতভাবেই নিঃসৃত। তাইতো বুদ্ধের নৈতিক শিক্ষার দার্শনিক তত্ত্ব হিসেবে প্রতীত্য সমুৎপদে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।