অথবা, প্রকৃত মজুরি কি কি বিষয়ের নির্ভর করে আলোচনা কর।
উত্তর: ভূমিকা : শ্রমিকের আর্থিক মজুরি অপরিবর্তিত থাকলেও বিভিন্ন কারণে প্রকৃত মজুরির পরিবর্তন ঘটে। যে সব উপাদানের উপর প্রকৃত মজুরি নির্ভর করে তা নিম্নে আলোচনা করা হল:
১. আর্থিক মজুরি: অন্যান্য অবস্থা স্থির থেকে যদি আর্থিক মজুরি বাড়ে, তবে প্রকৃত মজুরিও বাড়বে। যেমন- অন্যান্য অবস্থা স্থির রেখে শ্রমিকের শুধু বেতন স্কেল পূর্বাপেক্ষা দ্বিগুণ হলে, সে পূর্বাপেক্ষা অধিক দ্রব্য ও সেবা ভোগ করতে পারবে। ফলে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি পায়।
২. দামস্তর: দাম স্তরের পবির্তনে টাকার ক্রয় ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে এবং এতে প্রকৃত মজুরিও বাড়ে বা কমে।দ্রব্য মূল্য বাড়লে টাকার ক্রয় ক্ষমতা কমে এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দ্বারা পূর্বের তুলনায় কম পরিমাণ দ্রব্য সামগ্রি ক্রয় করতে পারে। এতে প্রকৃত মজুরি কমবে। পক্ষান্তরে, দাম কমলে টাকার ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দ্বারা পূর্বের তুলনায় অধিক জিনিস পত্র ক্রয় করা যাবে। এতে শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি বাড়বে।
৩. কাজের প্রকৃতিঃ কোন কাজ যদি কষ্টকর ও অপ্রীতিকর হয় তাহলে এ সকল কাজের আর্থিক মজুরি বেশি হলেও প্রকৃত মজুরি কম হয়। আবার, আরামদায়ক, সহজ, সরল ও সামাজিক মর্যাদাপূর্ণ কাজের আর্থিক মজুরি কম হলেও প্রকৃত মজুরি বেশি।
৪. কাজের স্থায়িত্ব:কাজের স্থায়িত্বের উপরও প্রকৃত মজুরি নির্ভর করে। স্থায়ী কাজের আর্থিক মজুরি কম হলেও প্রকৃতি মজুরি বেশি হবে। আবার, অস্থায়ী কাজের আর্থিক মজুরি বেশি হলেও প্রকৃত মজুরি কম হবে।
৫. কাজের সময়ঃ কাজের সময় ও অবসরের উপরও প্রকৃত মজুরি নির্ভর করে। ধরা যাক, ‘ক’ দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ করে এবং সপ্তাহে ২ দিন ছুটি ভোগ করে ৪০০০ টাকা মাসিক মজুরি পায়। ‘খ’ দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ করে এবং সপ্তাহে ১ দিন ছুটি ভোগ করে ৪০০০ টাকা মজুরি পায়। এ ক্ষেত্রে ‘খ’ এর চেয়ে ‘ক’ এর প্রকৃত মজুরি বেশি ।কারণ ‘ক’ অবসর সময় অন্যান্য কাজ করে অতিরিক্ত আয় করতে পারে।
৬. উন্নতির সম্ভাবনাঃ পদোন্নতির সম্ভাবনা, সাফল্যের আশা, চাকরির নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা যে সব কাজে থাকে, সে সব কাজের প্রকৃত মজুরি আর্থিক মজুরি অপেক্ষা অধিক হয়। যেমন- একজন ম্যাজিস্টেট পদোন্নতি পেয়ে এ.ডি.সি, ডি.সি কমিশনার কিংবা আরো উচ্চপদে উন্নতি হতে পারেন।
৭. অতিরিক্ত আয়ের সম্ভাবনাঃ যে সব কাজে অতিরিক্ত আয়ের সম্ভাবনা থাকে, সে সব কাজে প্রকৃত মজুরি বেশি হয়। যেমন- একজন শিক্ষক পরীক্ষার খাতা দেখে এবং বই লিখে অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। তাই শিক্ষকতা পেশায় প্রকৃত মজুরি বেশি হয়।
৮. সামাজিক মর্যাদাঃ যে চাকরি রুচি সম্মত মর্যাদা সম্পন্ন সে গুলোর আর্থিক মজুরি কম হলে ও প্রকৃত মজুরি বেশি। যেমন-একজন স্কুল শিক্ষক ও একজন করণীকের বেতন সমান হলেও স্কুল শিক্ষকের চাকরি অধিক মর্যাদা সম্পন্ন বলে প্রকৃত মজুরি বেশি।
৯. আনুষঙ্গিক সুবিধা: আর্থিক মজুরি ছাড়াও যে সব চাকরিতে আনুষঙ্গিক সুবিধা যেমন- বিনামূল্যে বাসস্থান, বিদ্যুৎ টেলিফোন সুবিধা, চিকিৎসার সুবিধা প্রভৃতি লাভের সুযোগ থাকলে প্রকৃত মজুরি বেশি হয়।।
১০. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণঃ যে সব পেশায় শ্রমিকদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়, সেসব পেশায় আর্থিক মজুরি কম হলেও প্রকৃত মজুরি বেশি হয়।
১১. অবসরকালীন সুবিধাঃ যে সকল পেশায় অবসরকালীন বোনাস, পেনশন, ভাল কাজের পুরস্কার প্রভৃতি সুবিধা বিদ্যমান থাকে, সে সব পেশায় প্রকৃত মজুরি অধিক হয়।
১২. পেশাগত খরচঃ যে সব কজের পেশাগত ব্যয় বেশি তাদের প্রকৃত মজুরি কম। যেমন- ডাক্তার, উকিল তাদের কাজের সুবিধার্থে মেশিন পত্র ক্রয়, সহকারি নিয়োগ প্রভৃতি কারণে খরচ বেশি হয়। কিন্তু একজন শিক্ষক ছাত্র পড়াতে হলে এসব ব্যয় করতে হয় না। ফলে ডাক্তার, উকিলের আর্থিক মজুরির তুলনায় প্রকৃত মজুরি কম হয়।
১৩. পরোক্ষ কর। সাধারণত প্রকৃত মজুরির উপর পরোক্ষভাবে প্রভাব রয়েছে। পরোক্ষ কর আরোপ করা হলে বা বৃদ্ধি করা হলে শ্রমিকের ভোগের পরিমাণ হ্রাস পায়। ফলে সীমিত আয়ের লোকদের প্রকৃত মজুরির পরিমাণ হ্রাস পায়।
১৪. শিক্ষাগত ব্যয়ঃ যে সব পেশায় চাকরি পাওয়ার আগে ব্যয় বহুল ও দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয় সেগুলোর ক্ষেত্রে শিক্ষাগত ব্যয়ের তুলনায় প্রকৃত মজুরি কম। যেমন- ডাক্তারী, প্রকৌশলী এবং সেনা বিভাগের চাকরিতে প্রকৃত মজুরি অপেক্ষাকৃত কম।
১৫. অবসরকালীন সুবিধাঃ যে সকল পেশায় অবসরকালীন বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা যেমন- বোনাস, পেনশন, ভবিষ্যৎ তহবিল, ভাল কাজের পুরস্কার প্রভৃতি সুবিধা বিদ্যমান থাকে, সে সব পেশায় প্রকৃত মজুরি অধিক হয়।
১৬. সামাজিক নিরাপত্তাঃ যে সব পেশায় কর্মরত শ্রমিকদের জন্য বেকারত্ব অসুস্থতা, পঙ্গুত্বের কারণে আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা থাকে, সে সব পেশায় আর্থিক মজুরি কম হলেও প্রকৃত মজুরি বেশি হয়।
১৭. কারখানা বা চাকরিস্থলের পরিবেশঃ যে যে স্থানে কাজ করবে, সে স্থানের পরিবেশ যদি উন্নত স্বাস্থ্যকর হয়, সে ক্ষেত্রে শ্রমিকরা দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারে। ফলে তাদের প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি পায়।
উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনায় দেখা যায়, প্রকৃত মজুরি বহু বিষয়ের উপর নির্ভর করে। প্রকৃত মজুরির গুরুত্ব বোঝাতে অধ্যাপক মার্শাল বলেন, শ্রমিক ধনী অথবা গরিব, সুস্থ অথবা অসুস্থ যাই হোক না কেন তার পুরস্কার আর্থিক মজুরির অনুপাতে না হয়ে প্রকৃত মজুরির অনুপাতে নির্ধারিত হয়।