অথবা, প্যারোলের সংজ্ঞা দাও। প্যারোলের শর্তসমূহ কি কি? প্রবেশন ও প্যারোলের বৈসাদৃশ্য লিখ।
অথবা, প্যারোল ধারণাটি ব্যাখ্যা কর। প্যারোলের শর্তসমূহ লিখ। প্রবেশন ও প্যারোলের বৈসাদৃশ্য আলোচনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : প্যারোল মূলত একটি সংশোধনমূলক কার্যক্রম। প্রবেশনের মতোই প্যারোল ব্যবস্থাতেও অপরাধীদের মুক্তি দিয়ে সংশোধনের সুযোগ করে দেয়া হয়। “সপ্তদশ শতাব্দীতে আমেরিকায় উপনিবেশসমূহে শ্রমিকদের প্রয়োজন দেখা দিলে ইংল্যান্ডের রাজা আদালতের সুপারিশে কতক সাংঘাতিক অপরাধে অভিযুক্তদের জন্য ধার্য করা শাস্তি সাময়িকভাবে স্থগিত রেখে তাদেরকে উপনিবেশগুলোর কন্ট্রাক্টরদের অধীনে নিয়োজিত আদেশ দিতেন। এরূপ নির্বাসিত অপরাধীদের মধ্যে কয়েকজন পালিয়ে যেত কিংবা লুকিয়ে ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করতো। পরবর্তীতে এরূপ নির্বাসিত অপরাধীদের চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এসব শর্ত ভঙ্গ করলে তাদেরকে পুনরায় কারাগারে অন্তরীণ করা হতো।” (ড. মোহাম্মদ সাদেক) “বিশেষ বিশেষ অপরাধীদের শর্তাধীনে মুক্তি দেয়ার এই প্রক্রিয়াই প্যারোল ব্যবস্থার ভিত্তি রচনা করে। বর্তমানে প্যারোল ব্যবহারের জন্য সরকারি আইন রয়েছে। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিভিন্ন দেশে প্যারোল ব্যবস্থা গৃহীত হয়। তবে ১৯২১ সালে আমেরিকার ৪৪টি রাজ্যে প্যারোল আইন কার্যকর হয় যা প্যারোল ব্যবস্থাকে অধিকতর যুগোপযোগী করে তুলতে সহায়তা করে।”
প্যারোলের ধারণা : প্যারোল অপরাধ সংশোধনের এমন একটি ব্যবস্থা যার মাধ্যমে দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত ব্যক্তি কিছুদিন দণ্ডভোগের পর কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে প্যারোল অফিসারের তত্ত্বাবধানে সাময়িকভাবে মুক্তিপ্রাপ্ত হন।অন্যভাবে বলা যায়, বিচারে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি কিছুদিন সাজাভোগের পর তার সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বেই বিশেষ শর্তাধীনে মুক্তিদানের ব্যবস্থাকে প্যারোল বলা হয়।
ড্রেসলার (Dressler) তাঁর “Practice and Theory of Probation and Parole” গ্রন্থে বলেন, “প্যারোল অপরাধ সংশোধনের এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে কিছুদিন শাস্তিভোগের পর অপারাধীকে একজন প্যারোল কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে সংশোধনের জন্য শর্তসাপেক্ষে যুক্তি প্রদান করা হয়।”
W.A.Frieldlander -এর মতে “প্যারোল হলো শাস্তির মেয়াদ শেষ হবার পূর্বে অপরাধীকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেবার প্রক্রিয়া।”
সমাজকর্ম অভিধানের (১৯৯৫) ব্যাখ্যানুযায়ী “প্যারোল হলো অপরাধীকে কারাগার হতে মুক্তিদানের এমন একটি আইনগত ব্যবস্থা যাতে দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীকে দণ্ডের মেয়াদ পূর্ণ হবার পূর্বেই কারাগারের মধ্যে তার সদাচরণ, অপরাধ না করার প্রতিশ্রুতি এবং ধারাবাহিক তত্ত্বাবধানের প্রেক্ষিতে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেয়া হয়।”
পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই প্যারোল ব্যবস্থা রয়েছে। সপ্তদশ শতকে বিচ্ছিন্নভাবে আমেরিকায় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এর ভিত্তিভূমি রচনা করে। এরপর ১৭৯০ সালে অস্ট্রেলিয়ায়, ১৮৫৩ সালে আয়ারল্যান্ডে, ১৮১৭ সালে আমেরিকার নিউইয়র্কে এবং ১৯২১ সালে আমেরিকায় প্রায় সবগুলো রাজ্যে এই ব্যবস্থা চালু হয়। বাংলাদেশেও বর্তমানে প্যারোল ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
প্যারোলের শর্ত
প্যারোল কতিপয় শর্তে প্রদান করা হয়। এগুলো হলো :
১. ভবিষ্যতে অপরাধ না করার অঙ্গীকার;
২. প্যারোল কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বাসা, পেশা ও ঠিকানা পরিবর্তন না করা;
৩. নিয়মিত ও নির্দিষ্ট সময়ে প্যারোল অফিসারের সাথে সাক্ষাৎ করা:
৪. প্যারোল অফিসারের উপদেশমতো চলা;
৫. সকলের সাথে সদাচরণ করা;
৬. শর্ত ভঙ্গ করলে পুনরায় জেলহাজতে থাকার অঙ্গীকার করা।
৭. সুবিধাজনক সময়ে প্যারোলে থাকা ব্যক্তির বাসা তল্লাশির অনুমতি দান।
৮. বিতর্কিত যে কোন কা
জ না করা।
৯. প্রয়োজন হলে স্বেচ্ছামূলক কাজে অংশগ্রহণ করা ইত্যাদি।
প্রবেশন ও প্যারোলের মধ্যে পার্থক্য
প্রবেশন ও প্যারোলের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন-
১. প্রবেশন ব্যবস্থায় অপরাধীকে কারাভোগের পূর্বেই মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু প্যারোল ব্যবস্থায় কিছুদিন সাজাভোগের পর অপরাধীকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেয়া হয়।
২. প্রবেশন ব্যবস্থা মূলত শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে কার্যকরী। প্যারোল ব্যবস্থা মূলত বয়স্ক অপরাধীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়;
৩. প্রবেশনের মেয়াদ স্বল্পকালীন। পক্ষান্তরে, প্যারোলের মেয়াদ দীর্ঘকালীন।
৪. প্রবেশনারকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মূলত আদালত; কিন্তু প্যারোলিকে মুক্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত দেয় প্যারোল বোর্ড।
৫. প্রবেশনের বিচারব্যবস্থা ঘরোয়া পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। পক্ষান্তরে প্যারোলের বিচারব্যবস্থা জনসম্মুখে হয়ে থাকে।
৬. প্রবেশনের শর্তভঙ্গ করলে বিচারের পুরো শাস্তি ভোগ করতে হয়। অন্যদিকে প্যারোলের শর্ত ভঙ্গ করলে বাকি মেয়াদের শাস্তি ভোগ করতে হয়।
৭. প্রবেশন ব্যবস্থায় অপরাধী হেয় প্রতিপন্ন হয় না। পক্ষান্তরে প্যারোলের পূর্বে অপরাধী জেল খাটার মাধ্যমে অনেকটাই হেয় প্রতিপন্ন হয়।
৮. প্রবেশন মূলত বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত।পক্ষান্তরে প্যারোল একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, সংশোধনমূলক কার্যাবলির মধ্যে একটি অন্যতম কার্যাবলি হলো প্রবেশন। এর মাধ্যমে অপরাধীদের কল্যণে বেশকিছু সুবিধা প্রদান করা হয়।