অথবা, পূর্ব বাংলায় অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ সৃষ্টিতে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিভিন্ন দিক আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন এবং স্বায়ত্তশাসন এর কথা বলা হয়। এর মাধ্যমে পূর্ব বাংলার মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ভাগ্য পরিবর্তন এর দিশা খুঁজে পায় এ কারণে পূর্ব বাংলায় মানুষ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনে সমর্থন করে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি
হলে পূর্ব বাংলার মানুষ আশাবাদী হয়ে ওঠে। কিন্তু খুব দ্রুত এ আশা বিনষ্ট হয় কারণ পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিম
পাকিস্তানের শাসকের শোষণমূলক নীতির মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদে পরিণত করে।
অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য : ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামোতে কোনো একটি বিদেশি শক্তি জোরপূর্বক একটি ভূখণ্ড বা সম্প্রদায়ের উপর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কঠোর দমননীতিতে স্থানীয়দের ক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শোষণের মাধ্যমে সেই ভূখণ্ড বা সম্প্রদায়কে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে দূর রাখার নীতি গ্রহণ
করে এবং সেই দেশের সভ্যতা সংস্কৃতি ধ্বংসের মাধ্যমে নিজেদের শোষণ ও শাসন শেষ পর্যন্ত অব্যাহত রাখে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও গবেষকগণ অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদের কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেন-
১. প্রভুত্বকারী শক্তি জোরপূর্বক ক্ষমতা ব্যবহার করবে।
২.সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে।
৩. উপনিবেশের শিল্প ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বদলে তাদের কাঁচামাল ও সম্পদ, অর্থ পাচার করে নিজের দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি করবে।
৪. উপনিবেশের সংস্কৃতি ধ্বংসে নিজেদের সংস্কৃতি জোরপূর্বক প্রয়োগ করবে।
পাকিস্তানের আমলে প্রায় চব্বিশ বছরের পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্কে বাঙালি রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ একে ‘অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ’ বলে অভিহিত করেছেন।
অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ সৃষ্টিতে অর্থনৈতিক বৈষম্যের গুরুত্ব : পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীরা প্রথম থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তারা বুঝতে পারে যে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হলে পূর্ব বাংলার মানুষ রাজনৈতিক সচেতন হবে এবং রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করবে। তাই তারা পূর্বের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চাৎভূমিতে পরিণত করে; যাতে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা উদ্ভব হতে না পারে।
উন্নয়ন পরিকল্পনায় বৈষম্য : পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিরা অত্যন্ত সুচতুরভাবে বৈষম্যের সৃষ্টি করে। প্রথম পঞ্চবার্ষিকীতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ব্যয় হয় মোট ১১৩ কোটি ৩ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা, অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ব্যয় হয় ৫০০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকীতেও সেই বৈষম্য বলবৎ রাখে এবং পূর্ব বাংলায়
উন্নয়ন ব্যয় ছিল ৯৫০ কোটি, ১,৩৫০ কোটি পশ্চিম পাকিস্তান এর উন্নয়ন ব্যয়।
জীবনযাত্রার মান নিম্ন : পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জীবনযাত্রার উন্নয়নের জন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ১৯৪৯-৫০ সালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে মাথাপিছু আয়ের বৈষম্য ছিল ২১.৯% এবং ২০ বছর পর ১৯৬৯-৭০ সালে এ বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৬১%। জনগণের মাথাপিছু আয় নিম্ন থাকার কারণে মানুষ তার জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যস্ত থাকে এবং রাজনৈতিক
অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে ব্যর্থ হয়।
আমদানি ও রপ্তানি : পূর্ব বাংলার মানুষের শোষণের আর একটি উপায় ছিল আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করা। পূর্ব বাংলা তার পরিশ্রম দিয়ে যে পরিমাণ রপ্তানি বাণিজ্য করতো সেই পরিমাণ আমদানি সুবিধা পেত না। ১৯৪৭-৭০ পর্যন্ত পাকিস্তানের রপ্তানির মোট আয়ের ৫৪.৭% ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অবদান কিন্তু আমদানির ক্ষেত্রে তাদের বঞ্চিত করে মাত্র ৩১.৯%।
বৈদেশিক ঋণ এর সাহায্য : বিদেশ থেকে অর্থ ঋণ এর যে প্রতিশ্রুতি পাকিস্তান পেয়েছিল তাতেও সুচতুর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা বাংলাকে বঞ্চিত করে। ১৯৪৭-৭০ পর্যন্ত পাকিস্তান মোট ৭,৬৪০ মিলিয়ন ডলার ঋণ পায় কিন্তু তার মধ্যে মাত্র ৩০% কাগজেকলমে পূর্ব বাংলাকে দেওয়ার কথা বললেও অনেক বাঙালি অর্থনীতিবিদদের মতে তা মোটেও ২১% এর বেশি ছিল না। যদিও জনসংখ্যার অনুপাতে বাংলার ৫৬% প্রাপ্য ছিল।
মুনাফা ও মূলধন আহরণ : পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা শুরু থেকেই সম্পূর্ণ পরিকল্পিত উপায়ে পূর্ব পাকিস্তানে, মুনাফা ও মূলধন গড়ে উঠতে দেয়নি। সকল ব্যাংক, বিমা, অফিস, আদালত, শিল্প, কারখানা পশ্চিমকে ঘিরে তৈরি করা হয় এর ফলে পূর্বের জনগণের হাতে পুঁজি জমতে পারেনি এবং তাদের শিল্প ক্ষেত্রে অনুন্নত করে রাখে।
পূর্ব বাংলার কাঁচামাল দিয়ে পশ্চিমে পাকিস্তানে শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে পূর্ব বাংলা পশ্চিম পাকিস্তানের কাঁচামালের যোগানদাতা ও উৎপাদিত পণ্যের বাজার হিসেবে পরিগণিত হয়।
বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ : পাকিস্তানের অর্থনৈতিক নীতি এমনভাবে নির্ধারিত হয় যে পূর্বের বাণিজ্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে। পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত ব্যবসায় বাণিজ্য নিয়ন্ত্রিত হতো মোট ৩৪টি পরিবারের মাধ্যমে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইস্পাহানি, বাওয়ানী, আদমজী প্রভৃতি। এদের মধ্যে মাত্র ২টি পরিবার পূর্ব বাংলার ছিল।
সম্পদের পাচার : অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ স্থাপনের গুরুত্ব হলো সম্পদের পাচার। পূর্ব বাংলা থেকে প্রায় ৩ হাজার মিলিয়ন রুপি প্রতিবছর পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতো এবং তাদের দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হতো।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, প্রথম থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে প্রভুত্বকারী শক্তি হিসেবে শাসন করতে চেয়েছে। তাই তারা সুচতুরভাবে পূর্বের সরকারের কাছ থেকে অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নিয়ে আসে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য ও সম্পদ পাচারের মাধ্যমে পূর্বের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে সেখানে অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।