নিয়মাবলী অনুসারে, আমি আপনাকে বর্তমান তারিখ সম্পর্কে জানাতে পারছি না।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যমূলক নীতিসমূহ আলোচনা করা হলো:
ভূমিকা:
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তান দুটি অংশে বিভক্ত ছিল – পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তান। ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন এই দুটি অংশের মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গভীর বৈষম্য বিদ্যমান ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ধারাবাহিকভাবে বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করে, যা ফলস্বরূপ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপ নেয়। এই বৈষম্যমূলক নীতিগুলো পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে গভীর অসন্তোষ ও বঞ্চনার জন্ম দিয়েছিল।
বৈষম্যমূলক নীতিসমূহ:
১. অর্থনৈতিক বৈষম্য:
- বাজেট বরাদ্দ: পশ্চিম পাকিস্তান সরকার উন্নয়ন বাজেট এবং বৈদেশিক সাহায্যের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করত। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল খুবই নগণ্য। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৫০-৬০ দশকে পূর্ব পাকিস্তান মোট রাজস্ব আয়ের প্রায় ৬০% সরবরাহ করলেও উন্নয়ন ব্যয়ের মাত্র ২৫-৩০% পেত।
- সম্পদ শোষণ: পূর্ব পাকিস্তানের উৎপাদিত পাট ও চা থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পায়ন ও উন্নয়নে ব্যয় করা হতো। পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পায়নের দিকে খুব কম মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল।
২. রাজনৈতিক বৈষম্য:
- ক্ষমতার কেন্দ্রিকতা: পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ও সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সিংহভাগ ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব ছিল খুবই সীমিত।
- গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব: পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য রাজনৈতিক দাবিগুলো উপেক্ষা করা হতো এবং গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা সীমিত করা হতো। বিভিন্ন সময় সামরিক শাসন জারি করে জনগণের অধিকার হরণ করা হয়েছিল।
৩. প্রশাসনিক বৈষম্য:
- চাকরিতে বৈষম্য: সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর উচ্চপদে পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য করা হতো। অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ পদেই পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হতো।
- প্রধান প্রশাসনিক দপ্তর: কেন্দ্রীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সব দপ্তর এবং সদর দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপন করা হয়েছিল, যা পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক গুরুত্ব কমিয়ে দেয়।
৪. সামরিক বৈষম্য:
- প্রতিরক্ষা ব্যয়: সামরিক বাহিনীর প্রায় ৯০% ব্যয় করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানে, অথচ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার জন্য খুব সামান্য বরাদ্দ ছিল।
- সৈন্য সংখ্যা ও নেতৃত্ব: সামরিক বাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানের সৈনিক ও অফিসারের সংখ্যা ছিল নগণ্য। সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ সকল স্থানে পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিযুক্ত ছিল।
৫. শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য:
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ: পশ্চিম পাকিস্তানে বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক বিনিয়োগ করা হয়েছিল, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানে এই ধরনের বিনিয়োগ ছিল খুবই সীমিত।
- শিক্ষার সুযোগ: পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদের জন্য উন্নত শিক্ষা এবং গবেষণার সুযোগ কম ছিল।
৬. সাংস্কৃতিক বৈষম্য:
- ভাষা বিতর্ক: ১৯৪৮ সালে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। বাঙালিরা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানালে তা অগ্রাহ্য করা হয়, যা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের জন্ম দেয়।
- সংস্কৃতির উপর আঘাত: পশ্চিম পাকিস্তান সরকার বাঙালি সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ঐতিহ্যের উপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করে নিজেদের সংস্কৃতি চাপানোর চেষ্টা করে।
৭. আইন প্রণয়নে বৈষম্য:
- আইনসভার প্রতিনিধিত্ব: জনসংখ্যার দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও, আইয়ুব খানের শাসনামলে “এক ইউনিট” নীতির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব হ্রাস করা হয়, যা তাদের আইন প্রণয়নে প্রভাব কমিয়ে দেয়।
- পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ উপেক্ষা: আইন প্রণয়নের সময় পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ ও প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে পশ্চিম পাকিস্তানের চাহিদা অনুযায়ী আইন তৈরি করা হতো।
৮. কৃষি ও শিল্প বৈষম্য:
- কৃষি উন্নয়ন: পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি খাতের উন্নয়নে খুব কম মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল, যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের কৃষি খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করা হয়।
- শিল্পায়ন: পূর্ব পাকিস্তানে ভারী শিল্প স্থাপনকে নিরুৎসাহিত করা হয়, যখন পশ্চিম পাকিস্তানে দ্রুত শিল্পায়ন ঘটে। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের পণ্যের বাজারে পরিণত হয়।
৯. যোগাযোগ ও অবকাঠামো বৈষম্য:
- পরিবহন ও যোগাযোগ: পশ্চিম পাকিস্তানে আধুনিক সড়ক, রেল ও বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটানো হয়, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে খুবই সীমিত বিনিয়োগ করা হয়।
- বন্দর উন্নয়ন: করাচি বন্দরের ব্যাপক উন্নয়ন করা হলেও চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের উন্নয়নে খুব কম গুরুত্ব দেওয়া হয়।
১০. সংবাদমাধ্যম ও গণমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ:
* প্রচারণার একচেটিয়া অধিকার: সরকারি সংবাদমাধ্যম, যেমন রেডিও পাকিস্তান ও পাকিস্তান টেলিভিশন, পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থে এবং সরকারের গুণগান প্রচারের জন্য ব্যবহৃত হতো। পূর্ব পাকিস্তানের খবর ও সমস্যাগুলো প্রায়শই চাপা দেওয়া হতো।
* বাক স্বাধীনতার অভাব: পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ও লেখকদের উপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল, যা তাদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশে বাধা দিত।
উপসংহার:
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এই বৈষম্যমূলক নীতিগুলো পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনে গভীর হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক বঞ্চনা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং প্রশাসনিক বৈষম্য তাদের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে তীব্র করে তোলে। এই নীতিগুলোই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি, যা ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম দেয়।
এই উত্তরটি প্রস্তুত করেছে রকেট সাজেশন বিডি এই অধ্যায়ের সকল প্রশ্নের উত্তর পেতে App ইন্সটল করুন