অথবা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় বাঙালিরা কী ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়?
অথবা, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যগুলো তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা : পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে পশ্চিমের স্বার্থলোভী শাসকগোষ্ঠীরা পরিকল্পিতভাবেই বাংলার মানুষদের অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত রাখে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাঙালিদের উল্লেখযোগ্য অবদান থাকলেও তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ হতো অত্যন্ত বৈষম্যমূলক। এর পিছনে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হীন ষড়যন্ত্র ছিল আর তা হলো পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করে পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তর করা। বাঙালি মানুষরা এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মাথানত না করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা : ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে মোট ৩ বার পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গৃহীত হয়। এ ৩টি উন্নয়ন পরিকল্পনায় পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ ছিল অত্যন্ত বৈষম্যমূলক এবং এ বৈষম্যকে ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানও স্বীকার করে নেয়। এ বৈষম্যকে দূর করার জন্য ১৯৬২ সালেই তিনি একটি ফাইন্যান্স কমিটি গঠন করেন এবং কমিটি দুই অঞ্চলের জনসংখ্যার অনুপাতে সম্পদ বণ্টনের সুপারিশ করে কিন্তু এ প্রস্তাব ব্যর্থ হয়।
প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা : প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৫৫-৫৯) পূর্ব বাংলার জন্য উন্নয়ন খাতে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৩০০ কোটি ২০ লক্ষ রুপি কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্যয় হয় মাত্র ১১৩ কোটি ৩ লক্ষ ৮০ হাজার অর্থাৎ মোট লক্ষ্যের ৩৭% অর্জন হয়। অপরদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল ৫০০ কোটি এবং মোট লক্ষ্যের ১০০% অর্জিত হয়। ব্যক্তিগত মালিকানা খাতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ৭৩ কোটি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ২৯৩ কোটি রুপি বিনিয়োগ করা হয়।
দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা : দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৬০- ৬৫) বৈষম্য হ্রাসের কথা বলা হলেও সেই সময় পূর্ব বাংলার উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ হয় ৯৫০ কোটি রুপি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের খাতে ১৩৫০ কোটি রুপি। বাঙালিদের চাপের মুখে এ বৈষম্য হ্রাসের জন্য পরিকল্পনার মোট বরাদ্দের ৪৫% বাঙালিদের দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও প্রকৃতপক্ষে দেওয়া হয় মাত্র ৩১%। ব্যক্তিগত খাতে পূর্ব বাংলায় বরাদ্দ পায় ৩০০ কোটি এবং পশ্চিম পাকিস্তান ১০৭০
কোটি রুপি । অর্থাৎ মোট বরাদ্দের মধ্যে পরিমাণ ২১.৯% ও ৭৮.১%।
তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা : ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানে তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা পেশ করা হয়। এতে দেখানো হয় যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ২৭,০০০ মিলিয়ন টাকা ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ২৫,০০০ মিলিয়ন টাকা বরাদ্দ হয়েছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখা যায় পূর্ব পাকিস্তানে খরচ করা হয় মাত্র ১০,৯৭০ মিলিয়ন বাকি টাকা পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে চলে যায়। মোট বরাদ্দের মধ্যে পূর্বের প্রাইভেট সেক্টরে বরাদ্দ পায় ৩৫% মাত্র এবং তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী মেয়াদ শেষে দুই
অঞ্চলের মধ্যে ২৩% বৈষম্য বৃদ্ধি পায় ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মূলত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীরা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে পূর্ব বাংলার অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল যাতে পূর্ব বাংলার মানুষ উঠে দাঁড়াতে না পারে এবং সবসময় পশ্চিমাদের অনুগ্রহের পাত্র হয়ে থাকে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীরা বুঝতে পারে যে অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল রাষ্ট্রের মানুষ কখনো শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারবে না। এ কারণে শাসকগণ তাদের ক্ষমতা ঠিক রাখার জন্য দিন দিন পূর্ব পাকিস্তান এর সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য বৃদ্ধি করতে থাকে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের প্রতিবাদের মুখ স্তব্ধ হয়ে যায়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এ ষড়যন্ত্র শেষ পর্যন্ত টিকতে পারে না। বাংলার মানুষ এক পর্যায়ে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে এবং এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে মুক্তির সংগ্রাম ঘোষণা করে।