অথবা, অনুকল্প বলতে কী বুঝ? অনুকল্পের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা কর।
অথবা, হাইপোথেসিস কী? হাইপোথেসিসের বৈশিষ্ট্যসমূহ বিশ্লেষণ কর।
উত্তর ভূমিকা : আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার মৌলিক উপাদান হলো পূর্বানুমান (Hypothesis)। বিজ্ঞানিভিত্তিক গবেষণায় অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে জ্ঞাত ও পর্যবেক্ষণকৃত পূর্বতন জ্ঞানের ভিত্তিতে গবেষক তার গবেষণাধীন বিষয় সম্পর্কে যে সাময়িক সিদ্ধান্তে উপনীত হন তাকে পূর্বানুমান বা অনুকল্প বলে। এর উপর ভিত্তি করেই মূলত সকল
গবেষণার গতি বা স্থিতি পরিচালিত হয়। এটি সামাজিক গবেষণার অন্যতম হাতিয়ার । পূর্বানুমান : Hypothesis শব্দটি দুটি গ্রিক শব্দ ‘Hypo’ এবং ‘Tithemi’ থেকে এসেছে, যার অর্থ যথাক্রমে Under এবং Place. অর্থাৎ পূর্বানুমান হচ্ছে Placed under known facts of the problem to explain
relationship between them.
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : কে. ডি. বেইলি (K. D. Bailey) এর মতে, “পূর্বানুমান হলো একটি অস্থায়ী ব্যাখ্যা, যার পরীক্ষায় প্রয়োজনীয় প্রমাণ প্রচ্ছন্ন হলেও বর্তমান।”
ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber) বলেন, “পূর্বানুমান হলো ক্ষণস্থায়ী ব্যাখ্যা, যা এর যৌক্তিক কিংবা বাস্তবিক ফলাফল প্রণয়নে যা পরীক্ষার জন্য প্রণীত হয়। বর্তমানে উপস্থিত প্রমাণসমূহের অপর্যাপ্ততার কারণে পূর্বানুমান একটি পরীক্ষণাধীন সেন্সটিজ (Selltiz) ও অন্যরা এ সম্পর্কে বলেন, “আমরা যখন কোনো সমস্যার সমাধান সম্বন্ধে অনুসন্ধান করি, তখন তার সম্ভাব্য কিছু অনুমান বা ব্যাখ্যা ছাড়া এক পা অগ্রসর হতে পারি না। আমাদের এই বাস্তব অভিজ্ঞতা আমাদের মনে উদিত হয়, আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে ও বিষয়বস্তুর জ্ঞান থেকে।”
ম্যাক এবং চ্যাম্পিয়ন (Black and Champion) এর মতে, “পূর্বানুমান হলো কোনো বিষয় সম্পর্কে আপাত স্থিরকৃত বিবৃতি (Statements) যা গবেষক সমর্থন করতে অথবা খণ্ডন করতে চায়।”
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, কোন গবেষণাকার্য সম্পাদনের জন্য নির্বাচিত এক বা একাধিত চলকের মধ্যে অনুমিত এবং যাচাইযোগ্য সম্পর্ককেই পূর্বানুমান বলে অভিহিত করা যায়। এটি মূলত তথ্য বা প্রস্তাবনা থেকে উদ্ভূত।
পূর্বানুমানের বৈশিষ্ট্য : একটি ব্যবহার উপযোগী এবং উত্তম পূর্বানুমানের বৈশিষ্ট্যাবলি নিম্নরূপ।
১. পূর্বানুমানটি প্রমাণসাপেক্ষ হতে হবে : একটি ভালো পূর্বানুমানের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, পূর্বানুমানটি প্রমাণসাপেক্ষ হতে হবে। পূর্বানুমানটি এমনভাবে ব্যক্ত করতে হবে যেন সেটি থেকে যৌক্তিক অনুসিদ্ধান্ত গঠন করা যায় এবং এ অনুসিদ্ধান্তগুলো বাস্তব ঘটনা বা তথ্যের সাহায্যে সত্যায়িত করা যায়। বাস্তব ঘটনা বা উপাত্ত যদি কোনো পূর্বানুমানকে সমর্থন না করে তাহলে পূর্বানুমানটি বর্জন করতে হবে।
২. বাস্তব অভিজ্ঞতাভিত্তিক : উত্তম পূর্বানুমান বাস্তব অভিজ্ঞতাভিত্তিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিভিন্ন গবেষণাধর্মী পুস্তক, রচনা, সাময়িকী এবং গবেষণা প্রতিবেদন অধ্যয়ন হতে অর্জিত জ্ঞান এবং গবেষকের নিজস্ব বিচক্ষণতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পূর্বানুমানটি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
৩. প্রত্যয়গত দিক থেকে সুস্পষ্ট হতে হবে : পূর্বানুমান প্রত্যয়গত দিক হতে সুস্পষ্ট হতে হবে। এটি গবেষকের ব্যক্তিগত ব্যাপার হলে চলবে না বরং অন্যের বোধগম্য হতে হবে। এ কারণে প্রকল্পে ব্যবহৃত প্রত্যয়সমূহের সুস্পষ্ট ও কার্যকরী সংজ্ঞা প্রদান করা বাঞ্ছনীয়। কোনো পূর্বানুমানকেই উত্তম এবং ব্যবহার উপযোগী বলা যাবে না যদি না তা প্রত্যয়গত দিক হতে সুস্পষ্ট না হয়।
৪. এটিকে সুনির্দিষ্ট হতে হবে: পূর্বানুমানের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এটি অবশ্যই সুনির্দিষ্ট হতে হবে। অর্থাৎ গবেষণার উদ্দেশ্য অনুসারে যে পূর্বানুমানটি ধরে নেয়া হয়েছে সেটি যে কোনো এক বা একাধিক বিষয়ের উপরে সুনির্দিষ্টভাবে রচিত হতে হবে। বস্তুত সকল কাজ বা Operation এবং Prediction বা ভবিষ্যদ্বাণী সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে হবে। সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করা যায় এমন বিষয়গুলোই কেবল একটি পূর্বানুমানের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। যেমন- রাজনৈতিক কার্যালয়, পেশা, আয়, শিক্ষা ইত্যাদি উত্তম পূর্বানুমানের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কতকগুলো পদ। একটি পূর্বানুমানকে সুনির্দিষ্ট করতে হলে একে দুটি Sub hypothesis এ ভাগ করা যেতে পারে। কারণ এর ফলে দুই বা ততোধিক চলকের মধ্যে সম্পর্ককে আরো স্পষ্ট ও সহজভাবে উপস্থাপন করা যায়।
৫. পূর্বানুমানকে প্রচলিত কৌশলাদির সাথে সম্পর্কযুক্ত থাকতে হয় : একটি উত্তম পূর্বানুমানকে প্রচলিত কৌশলাদির সাথে সম্পর্কযুক্ত থাকতে হয়। কারণ তত্ত্ব এবং পদ্ধতি পরস্পর বিরোধী নয় বরং সম্পর্কযুক্ত। একজন তাত্ত্বিক জানেন না- পূর্বানুমানের জন্য পর্যাপ্ত কৌশলসমূহ কি? এজন্য তাকে বিভিন্ন পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হয়। বর্তমান সময়ে পূর্বানুমান যাচাই কঠিন হলেও তা (কৌশল) কে এড়িয়ে চলতে পারে না বিধায় তাকে কোনো না কোনো কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়।
৬. কাঠামোগত তত্ত্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে হবে : একটি উত্তম পূর্বানুমানকে অবশ্যই কাঠামোগত তত্ত্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে হবে। অর্থাৎ এর তাত্ত্বিক ভিত্তি থাকতে হবে। বহুক্ষেত্রেই একটি গবেষণা পূর্বানুমান প্রণয়ন করার উদ্দেশ্য হলো কোন একটি প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের সপক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করা। তবে অনেকক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব না থাকলে পূর্বানুমানটি একটি নতুন তত্ত্বের ভিত্তি হতে পারে। তবে পূর্বানুমানটি অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
৭. পর্যবেক্ষণযোগ্য বিষয়ের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত হতে হবে : একটি উত্তম পূর্বানুমানকে অবশ্যই পর্যবেক্ষণযোগ্য বিষয়ের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত হতে হবে। পর্যবেক্ষণযোগ্য সকল বিষয় বা ঘটনার সাথে অবশ্যই পূর্বানুমানটিকে সম্পর্কিত হতে হবে এবং পর্যবেক্ষণযোগ্য যাবতীয় ঘটনাগুলো হতে অপ্রাসঙ্গিক ও
অপ্রয়োজনীয় ঘটনাসমূহ বাদ দিয়ে মূল ঘটনাসমূহ নির্বাচন করতে হবে, যার সাথে পূর্বানুমানের ঘনিষ্ঠতা থাকবে।
৮. সরল এবং সংক্ষিপ্ত হতে হবে : একটি পূর্বানুমানকে অবশ্যই যৌক্তিকভাবে সরল এবং সংক্ষিপ্ত হতে হবে। অর্থাৎ পূর্বানুমানটিকে যৌক্তিকভাবে সংগতিপূর্ণ ও অর্থপূর্ণ হতে হবে। পূর্বানুমান সংক্ষিপ্ত হলে গবেষক ও গবেষণার জন্য মঙ্গলজনক । অপেক্ষাকৃত সরল ও অল্পসংখ্যক মৌলিক ধারণার সাহায্যে কোনো ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হলে জটিল ও বেশি সংখ্যক ধারণার অবতারণা করা উচিত নয় ।
৯. ভবিষ্যদ্বাণী প্রদানে সক্ষম হতে হবে : একটি উত্তম পূর্বানুমানকে অবশ্যই ভবিষদ্বাণী প্রদানে সক্ষম হতে হবে । কেননা ভবিষ্যদ্বাণী বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ভবিষ্যদ্বাণী না করতে পারলে কোনো পূর্বানুমানকে উত্তম ব্যবহার উপযোগী পূর্বানুমান হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না।
১০. যুক্তিসংগত ধারণার সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে হবে : একটি উত্তম পূর্বানুমানকে অবশ্যই যুক্তিসংগত ধারণার সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে হবে । অর্থাৎ যুক্তিসংগত ধারণার প্রকাশক হতে হবে। অন্যথায় পূর্বানুমানটির সত্য-মিথ্যা যাচাই করা যাবে না।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, একটি পূর্বানুমানের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে গবেষককে অত্যন্ত সচেতনভাবে অগ্রসর হতে হয়। কেননা পূর্বানুমানের কাজ হলো গবেষণার দিকনির্দেশ করা, গবেষণার সমস্যার সমাধানের ইঙ্গিত দেয়া এবং জ্ঞানের বিকাশ বা উন্নতি সাধন করা। প্রকৃতপক্ষে একটি উত্তম পূর্বানুমান ছাড়া কোনো গবেষণা সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারে না। তাই বলা যায়, Hypothesis is the pivot of the whole study.
অর্থাৎ, পূর্বানুমানই সমস্ত গবেষণা কার্যক্রমকে পরিচালিত ও দিকনির্দেশনা দান করে।