পাকিস্তানে বিরোধী রাজনৈতিক দলের ক্রমবিকাশ আলোচনা কর।

অথবা, পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরোধী দলগুলোর গঠন এবং কার্যক্রম বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব পর্যন্ত মুসলিম লীগ সর্বশ্রেণির জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী দল হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই এ দলটির ক্ষমতাসীন নেতৃবৃন্দ নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের পন্থা হিসেবে দলীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করতে থাকে। ফলশ্রুতিতে আস্তে আস্তে এ দলের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পেতে থাকে। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে পাকিস্তানে কতিপয় মুসলিম লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হয়। প্রকৃতপক্ষে, মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী মনোভাব এবং গণস্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপই পাকিস্তানের রাজনীতিতে শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক দল সৃষ্টির পথকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল।
পাকিস্তানে বিরোধী রাজনৈতিক দলের উৎপত্তি ও বিকাশ : নিচে পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরোধী দলের উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. আওয়ামী মুসলিম লীগ : ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ পাকিস্তানের প্রথম শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। এ দলের প্রতিষ্ঠাতাগণের প্রায় সকলেই ছিলেন মুসলিম লীগের সাথে সম্পৃক্ত। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পর থেকেই বিভিন্ন প্রশ্নে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মুসলিম নেতৃবৃন্দের জনবিরোধী কার্যকলাপে অতিষ্ঠ হয়ে মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল তরুণ সম্প্রদায় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ
গার্ডেনে প্রায় ৩০০ জন প্রতিনিধির উপস্থিতিতে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করে। এ দলের সভাপতি নির্বাচিত হন
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৪৯ সালের ২৪ জুন মুসলিম লীগের হুমকি উপেক্ষা করে এ দলের প্রকাশ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে। আওয়ামী মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
২. কৃষক শ্রমিক পার্টি : বাংলার কৃষক দরদি নেতা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের রাজনৈতিক দলের নাম ছিল কৃষক শ্রমিক পার্টি’ । তিনি প্রথমে যদিও মুসলিম লীগের সাথে জড়িত ছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে দ্বন্দ্বের কারণে আলাদা দল গঠন করেন। তার দল ছিল পূর্ব বাংলার কৃষক শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষণে সোচ্চার।
কৃষক শ্রমিক পার্টি ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের সাথে যুক্ত হয়ে নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৩. জামায়াতে ইসলামী : জামায়াতে ইসলামী হচ্ছে ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ একটি পুরাতন রাজনৈতিক দল। অবিভক্ত ভারতে ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ’ নামে এ দলটি আত্মপ্রকাশ করে। দলটি প্রথমে ভারত বিভক্তির বিরোধিতা করলেও পরবর্তীতে তা মেনে নেয়। দেশ বিভক্তির পর
দলটি ‘জামায়াতে ইসলামী’ দল নামে তাদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানে এর কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৫১ সালে।
৪. নেজামে ইসলামী : মাওলানা আতাহার আলীর নেতৃত্বে গঠিত ‘নেজামে ইসলামী’ ছিল একটি ধর্মীয় রক্ষণশীল দল। সাধারণ জনগণের কাছে এ দলটির তেমন কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। তাই তারা অন্যান্য বিরোধীদল যথা : আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি প্রভৃতি দলের সাথে একত্রিত হয়ে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এ দলটি ধর্মীয় গোঁড়ামি ‘জামায়াতে ইসলামীর’ মতো এতটা কট্টর ছিল না। এ দল ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টেরও সদস্য ছিল। পূর্ব
পাকিস্তানে এ দলের নেতা ছিলেন ফরিদ আহমদ চৌধুরী।
৫. পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি : ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পরবর্তীতেও কমিউনিস্ট পার্টি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অংশ হিসেবে কাজ করত। ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্টের কলকাতা সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সদস্য সাজ্জাদ জহিরকে সাধারণ সম্পাদক করে ‘পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ পার্টি গঠিত হওয়ার পর থেকে তারা বিপ্লবী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এ দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী ছিল হিন্দু, তাই মুসলিম লীগ সরকার এদের বিরুদ্ধে দমননীতি গ্রহণ করে।
৬. পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস : পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই ‘পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ পূর্ব বাংলার আইনসভা এবং পাকিস্তান গণপরিষদে বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা রাখতে থাকে। তবে কংগ্রেস ছিল হিন্দু নেতৃত্ব দ্বারা প্রভাবিত। এই৷তাই কংগ্রেস হিন্দুদের স্বার্থ নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকত। এ দলটি পাকিস্তানের শুরু থেকেই ভাষা আন্দোলন তথা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এ দল হিন্দুত্ববাদী দল বলে পাকিস্তান সরকার শুরু থেকেই এ দলটিকে ভারতের দালাল, গুপ্তচর প্রভৃতি আখ্যা দিয়ে এদের উপর দমননিপীড়ন অব্যাহত রাখে। অন্যদিকে, দেশ বিভাগের
পর এদেশের অভিজাত হিন্দু সম্প্রদায় যারা রাজনীতিতে সোচ্চার ভূমিকা পালন করত, তারা এদেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়। ফলে এ দলটি আস্তে আস্তে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তবে এ দলের কতিপয় নেতাকর্মী পরবর্তীতে অন্যান্য রাজনৈতিক দলে যোগ দেয়।
৭. গণতন্ত্রী দল : ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসে হাজী মোহাম্মদ দানেশের নেতৃত্বে ‘গণতন্ত্রী দল’ নামে একটি৷ অসম্প্রদায়িক দল গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালে এ দল প্রাদেশিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার লক্ষ্যে যুক্তফ্রন্টের সাথে একত্রিত হয়। এ দলের লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সমাজতান্ত্রিক সমাজ।
৮. ন্যাশনাল পার্টি : এটি ছিল একটি বামপন্থি সংগঠন। এ দলের নেতৃবৃন্দের মধ্যে মিয়া ইফতেখার উদ্দিন, আবদুল গাফফার খান, জি. এম. সৈয়দ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এ দল পরবর্তীতে গণতন্ত্রী দল ও মওলানা ভাসানীর সমর্থকদের সাথে একত্রিত হয়ে যায়।
৯. ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী) : আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালে ২৫ জুলাই ঢাকায় এক সম্মেলনে গণতন্ত্রী দল ও ন্যাশনাল পার্টির সমর্থকদের সমন্বয়ে ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। মওলানা ভাসানী এ দলের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন৷ পশ্চিম পাকিস্তানের মাহমুদুল হক ওসমানী। ১৯৬৭ সালে এ দলের কিছু সমর্থকদের মধ্যে আদর্শগত বিরোধ দেখা দেয় এবং ত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ দলটি পূর্ব ও পশ্চিম উভয় প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনের দাবির পক্ষে আন্দোলন অব্যাহত রাখে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানে সরকার বিরোধী দল হিসেবে অনেকগুলো রাজনৈতিক দলই আত্মপ্রকাশ করে। তবে অনেকগুলো দলের মধ্যেই আদর্শগত বিরোধ দেখা দেওয়ার ফলে এরা রাজনীতিতে প্রবল ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। অবশ্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফ্রন্ট গঠনের মাধ্যমে বিরোধী দলগুলো অনেক ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে।